বদলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ

8 hours ago 3

প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলার আর্থ-সামাজিক সম্ভাবনা যেমন অধিক, তেমনি সমস্যাগুলোও বেশ জটিল। স্বাধীনতার পর থেকেই যেন এই জেলার মানুষ অবহেলিত হয়ে আসছে। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখানে তুলনামূলক উন্নয়ন হয়নি। অনেক কিছুতেই নারায়ণগঞ্জ জেলা অন্যান্য জেলা থেকে পিছিয়ে। তবে অনেক দেরিতে হলেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জেলায়।

জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পরিষ্কার, সবুজায়ন, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, শহরকে যানজটমুক্ত করতে একগুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই ‘গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ’ কর্মসূচির আওতায় নগরকে ঢেলে সাজাচ্ছেন তিনি।

গত ১১ মার্চ জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসক ঘোষণা দেন ‘গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ’ নামে একটি ব্যাপক পরিবেশ পুনর্গঠন কর্মসূচির। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে চাষাড়া লিংক রোড পর্যন্ত ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও প্লাকার্ড অপসারণ করা হয়। ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে এই কার্যক্রম, যা এখনো চলমান।

বদলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ

‘নারায়ণগঞ্জ হবে সবুজে ঘেরা, প্রাচ্যের ড্যান্ডি হবে বিশ্বসেরা’ স্লোগানে শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জকে সবুজে ঘিরে দেওয়ার পরিকল্পনায় দুই মাসের মধ্যেই জেলায় এক লাখ বৃক্ষরোপণ করা হয়। সবুজায়নের এই উৎসব চলে উপজেলাগুলোতেও। জেলার পাঁচটি উপজেলা, ৩৯টি ইউনিয়ন, পাঁচটি পৌরসভা এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়।

১১৭টি নির্ধারিত স্পট, ৪২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ৩১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৮০.৩ কিলোমিটার সড়ক এবং চার কিলোমিটার খালপাড়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। দেশি-বিদেশি ৪৮টি প্রজাতির গাছের মধ্যে রয়েছে চেরি, পিংক ট্রাম্পেট, জাকারান্ডা, ফক্সটেল পাম, গ্লোরিয়া সিরিয়া ও রেইন ট্রি।

পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করতে সিটি করপোরেশনের বাইরে ফতুল্লা সদর উপজেলার প্রতিটি ওয়ার্ডে দুটি করে ওয়েস্ট বিন স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেন জেলা প্রশাসক। এরইমধ্যে এ কর্মসূচির আওতায় ১০০টি ওয়েস্ট বিন স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে।

বদলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ

জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পরিষ্কার

নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রায় ৯২ কিলোমিটার খাল রয়েছে, যার ১৭ কিলোমিটার অবৈধ দখলসহ নানা কারণে একেবারে ব্লক হয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ ছিল। যে কারণে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা প্রায় সময়ই জলাবদ্ধ থাকতো। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় খাল পরিষ্কার, সংস্কার ও উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলা সদরের কাশিপুর ইউনিয়নের কল্যানী খাল, ফতুল্লার ওয়াবদারপুল খাল, লালপুর এলাকার ড্রেন ও নালা পরিষ্কার, জালকুড়ির জলাশয়ে কচুরিপানা ও আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে।

কংস খাল, ফতুল্লা খাল ও শিকদারবাড়ি খাল পরিষ্কার করে প্রবাহমান করা হয়েছে। একইসঙ্গে খালগুলোর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে তিন হাজার ৫২৪ ট্রাক বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ১১ কিলোমিটার খাল। অসচেতন মানুষ যাতে আবারও ময়লা ফেলে খাল ভরাট না করে, সেজন্য বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লিফলেট বিতরণ করা হয়। বন্দর উপজেলার সোনাকান্দা-কলাগাছিয়া খাল, সোনারগাঁওয়ের পঙ্খিরাজ ও বস্তল খালসহ আরও বেশকিছু জলাশয় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন

জেলার দুই সরকারি হাসপাতাল ৩০০ শয্যা খানপুর হাসপাতাল এবং নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালকে ‘গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ’র অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখানে সেবার মান বৃদ্ধি, পরিচ্ছন্নতা এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশ গঠনে নেওয়া হয় বিশেষ পদক্ষেপ। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নবজাতকদের জন্য আধুনিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (এনআইসিইউ) চালু করা হয়েছে। সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম রোধে নেওয়া হয়েছে কার্যকর ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় টেস্টিং কিটসহ ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

বদলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ

পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা

পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে ‘গ্রিন আমব্রেলা’ কর্মসূচির আওতায় জেলার বাসচালক ও হেলপারদের জন্য কার্যকর ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সূচনা করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো জেলার বাসচালক ও হেলপারদের দেওয়া হচ্ছে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও ইউনিফর্ম। পাশাপাশি তাদের জন্য ‘গ্রিন অ্যাকাউন্ট’ নামের কল্যাণ ফান্ড সুবিধা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সকল সব বাসচালকর ও হেলপারদের। সেইসঙ্গে গাড়িচালকদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য সম্বলিত একটা ডেটাবেস তৈরি করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম হোসেন বলেন, ‘এর আগে কোনো জেলা প্রশাসক আমাদের নিয়ে এভাবে চিন্তা করেননি। বর্তমান জেলা প্রশাসক আমাদের জন্য অনেক কিছু করে দিয়েছেন।’

শহরকে যানজটমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ

শহরের যানজট নিরসনে অটো, ইজিবাইক, সিএনজির নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি আলাদা স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে দখলে থাকা শহরের মীর জুমলা রোডকে হকারমুক্ত করে বাস চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। বিভিন্ন রাস্তা মেরামত এবং দীর্ঘদিনের অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক ভলান্টিয়ার নিয়োগের মাধ্যমে যানজট দৃশ্যত কমেছে। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের নিয়মিত অভিযানে রাস্তায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে; ফলে সড়কে ফিরছে শৃঙ্খলা।

নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে নতুন অত্যাধুনিক কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে। গত ২৬ মার্চ ট্রেন সংযোজন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ডিসি।

বদলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ

‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ সংগঠনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান জেলা প্রশাসক যোগদানের পর থেকেই নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নানামুখী পদক্ষেপের কারণে নারায়ণগঞ্জের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।’

গ্রিন ফর ফিসের চেয়ারম্যান শরীফ মো. আরিফ মিহির জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি এক লাখ বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার ও সংস্কার করা হয়েছে। সবমিলিয়ে তিনি পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তার কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই।’

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জে যোগদানের পরই নানা সমস্যা দেখতে পাই। যোগদানের আগে মনে করেছিলাম হয়তো নারায়ণগঞ্জ অনেক উন্নত হবে। কিন্তু এখানে আসার পর আমি অবাক হয়ে যাই। ঢাকার সঙ্গে একটি জেলা এমন থাকবে সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নানামুখী পদক্ষেপ নিই। নারায়ণগঞ্জবাসীর সহযোগিতায় এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। আশা করছি নারায়ণগঞ্জবাসী এর সুফল ভোগ করবেন।’

এসআর/এমএস

Read Entire Article