জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ এক মারাত্মক সমস্যা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং দিন দিন এই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো আরো বেড়েই চলছে। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মধ্যে বায়ু অন্যতম। নির্মল ও পরিচ্ছন্ন বায়ু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অনিবার্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক। তাই বায়ু দূষণ প্রতিরোধ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
সম্প্রতি "বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০২৫" বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় শীর্ষক বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এর উদ্যোগে আলোচনায় জানা যায় ঢাকায় গত ৯ বছরে মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বা ভালো বায়ুতে নিশ্বাস নিতে পেরেছে। আর বিগত ২০২৪ সালে মানুষ সবচেয়ে ভালো বায়ুমান পেয়েছে মাত্র ২ দিন এবং সবচেয়ে খারাপ বায়ুমান ছিল ৩৫ দিন। সংস্থাটি বলছে ঢাকাবাসী ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে (৩,১১৪ দিন) মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিয়েছে, যা গত ৬ বছরের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ সময়। এছাড়া ৬২৪ দিন (২০%) মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন (২৮%) সংবেদনশীল বায়ু, ৮৫৩ দিন (২৭%) অস্বাস্থ্যকর, ৬৩৫ দিন (২১%) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৯৩ দিন (৩%) পেয়েছে দুর্যোগপূর্ণ বায়ু। ২০২৪ সালের সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের দিন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ ও ৩৫ দিন।
বায়ু দূষণের কারণ ও উৎস: পরিবেশ সচেতনতা এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এবং পরিবেশ দূষণ পরস্পরের কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর যানবাহনের কালো ধোঁয়া, বিশেষ করে মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকেই বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া, যা বিষাক্ত। বায়ু দূষণের ২৮% এর জন্য দায়ী যানবাহনের ধোঁয়া। এছাড়া কারখানা ১৩%, ইটভাটা ১১% এবং নির্মাণ প্রকল্পের ধুলোবালি ৮%, বাকি অংশ আসে আবর্জনা পোড়ানো, গৃহস্থালির ধোঁয়া ও জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার থেকে।
অপরিকল্পিত অবৈধ এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে ইটভাটার কার্যক্রম চালানো, যা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন ও শিল্প কারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, উন্মুক্তভাবে ইট-বালি পরিবহণ করা, ভবন নির্মাণের সময় খোলা জায়গায় অথবা রাস্তার উপরে সেগুলো রেখে দেওয়া, বিভিন্ন রাস্তায় ইট ভাঙা এবং যত্রতত্র ইটের টুকরা, বালি, মাটি, পলিথিন ফেলে রাখা, বিভিন্ন রকমের নির্মাণকার্য, সড়ক খণ্ডন এবং বর্জ্য দহন বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণও স্পষ্ট, এমনকি নববর্ষ উদ্যাপনে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
অনেক স্থানে মহাসড়কের পার্শ্বে ফেলা হয় ময়লা, রাতের আঁধারে লরি ও ভ্যানে নিয়মিত ফেলা হচ্ছে বাসা বাড়ি ও কারখানার বর্জ্য। আবর্জনার স্তুপ, দূষিত বায়ু আর দুর্গন্ধ নগরবাসীর জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। আবর্জনার স্তুপ থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ বৃষ্টির জলের সহিত মিশে নিকটস্থ জলাশয়গুলিকে দূষিত করছে এবং এর সাথে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রায়ই দেখা যায় উন্মুক্ত স্থানে পলিথিন ও বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে মিশছে আরও বিষাক্ত ধোঁয়া। এসব কার্যকলাপ পরিবেশ দূষণকে আরো তীব্র করে তুলছে এবং নগরবাসীকে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন করছে, যা উদ্বেগজনক।
আবার এসব ময়লা সবসময় ফেলা হলেও নিয়মিত ডাম্পিং এর অভাব দেখা যায় বা করা হয় না। তাই মহাসড়কের পার্শ্বে প্রায়ই দেখা যায় ময়লার স্তূপ। এছাড়া পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকার কারণে দিন দিন কার্বন ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর কমছে অক্সিজেন। কারণ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে গাছ, আর বাতাসে ছাড়ে অক্সিজেন। বড় শহরে ১০-১২% জলাভূমি থাকতে হয়, আছে ৩% এর কম। সবুজ থাকতে হয় ১৫%, আছে ৭%।
বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিবেশ আর নির্মল দূষণমুক্ত বায়ু। আমাদের রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, বাড়িঘরসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক যেমন প্রয়োজন, তেমনি বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করাও জরুরি। তাই বায়ুদূষণ রোধ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানো অতীব জরুরি। মানব স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় প্রশাসনকে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমন্বিত ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। শুধু সরকার নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ ও নির্মল বাতাস।
কি কি স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে: বায়ুদূষণের ফলে স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ধুলাবালি নাক-মুখ দিয়ে শ্বাসতন্ত্রে আক্রান্ত করে বেশি। প্রথমেই চোখ-নাক আক্রান্ত হওয়ার ফলে চোখ লাল হয়, পানি ঝরে, অ্যালার্জি হয়। নাকে প্রবেশ করে নাক বন্ধ হওয়া, নাকে পানি, অনবরত হাঁচি, নাকে অ্যালার্জি বা রাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস এমনকি নাকে রক্তক্ষরণও হতে পারে। মুখে প্রবেশ করলে টনসিল, ফ্যারিংস, ল্যারিংসে প্রদাহ হয়ে কাশিসহ গলার স্বর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ু দূষণে অ্যালার্জি, সোরিয়াসিসসহ বিভিন্ন চর্ম রোগের জন্য হতে পারে মারাত্মক। শ্বাসনালী ও ফুসফুসে আক্রান্তের ফলে সাধারণ কাশি, এ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, এমফাইসিমা, সিওপিডি, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশনের প্রকোপ বাড়তে পারে।
এভাবে দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুর গ্রহণের প্রভাবে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগ যেমন হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্ক, লিভার ও কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গের রোগ হতে পারে। বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক, শিশু ও জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষেরা। সবচেয়ে ক্ষতি হয় শিশুদের, বায়ুতে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হয় এবং স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে।
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এখন বায়ু দূষণ। বিশ্বে এ বয়সে যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার এক চতুর্থাংশের বেশির জন্য দায়ী বায়ু দূষণ। গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি, গর্ভের সন্তানের ওজন কম হওয়া ও অকাল প্রসব, জন্মগত ত্রুটি, মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার মত ঝুঁকি বাড়তে পারে। এছাড়া বায়ুতে সীসার পরিমাণ বেশি থাকলে স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, পেটের পীড়াসহ রক্তশূন্যতার মত জটিল রোগের সম্ভাবনা বেশি হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু হয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষের। এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক, হৃদ্রোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, সিওপিডি, ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ। এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বায়ুদূষণ প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৫২ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ বলে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৩২ লাখ মানুষ রান্নাবান্না ও গৃহস্থালিজনিত বায়ুদূষণের শিকার হয়ে মারা যায়।
প্রতিরোধে করণীয়: পরিবেশ দূষণ এড়ানোর জন্য শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। নিজেরা আগে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বা ময়লাগুলো পুড়িয়ে ফেলার মতো নানা ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্ভব হলে বর্জ্য দহনের ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বন্ধে বর্জ্য হইতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যে-কোনো উন্নয়নমূলক কাজ তো বন্ধ রাখা যাবে না, তাই উন্নয়নমূলক কাজের সাথে সাথে আইন মেনে ও যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভাব্য দূষণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইটভাটার কার্যক্রম চালানো, পরিবেশ সম্মত ইট উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ এবং কারখানাগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশন ধোঁয়া কমিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, এমনকি নতুন কারখানা তৈরির সময় পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানায় বিশ্বমানের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মান নির্ধারণ এবং উহার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরি।
মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুপযুক্ত এবং পুরাতন যানবাহন পরিবর্তন করতে হবে, যানবাহনে আধুনিক নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নসহ উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে এবং ট্র্যাফিক জ্যামের সমাধান করতে হবে। নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন স্থাপন এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ব্যাপারে শহরবাসীকেও সচেতন হতে হবে, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মাবলি মেনে চলতে হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রচুর বনায়ন করতে হবে, গাছ লাগানো ও ছাদ বাগান সম্প্রসারণ করতে হবে, কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। জলাশয় বৃদ্ধির জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তিগত সতর্কতার কোনো বিকল্প নাই। নিজেদের ঘর-বাড়ি প্রতিদিন ভালোভাবে ধুয়ে মুছে রাখতে হবে যাতে ধুলা না জমে। আর বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিবেশ আর নির্মল দূষণমুক্ত বায়ু। আমাদের রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, বাড়িঘরসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক যেমন প্রয়োজন, তেমনি বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করাও জরুরি। তাই বায়ুদূষণ রোধ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানো অতীব জরুরি। মানব স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় প্রশাসনকে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমন্বিত ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। শুধু সরকার নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ ও নির্মল বাতাস।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এইচআর/জেআইএম

2 hours ago
6









English (US) ·