‘ভালো সুযোগ পেলে ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতাম না’

7 hours ago 5

‌‘যদি আরও ভালো কোনো উপায় থাকতো, তাহলে কেউ সমুদ্রে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতো না। কিন্তু এর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিই।’

কথাগুলো আফ্রিকার দেশ গিনি থেকে আসা ১৫ বছর বয়সী এক বালকের। বার্লিন-ভিত্তিক এনজিও এসওএস হিউম্যানিটি সঙ্গীবিহীন এই নাবালককে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকা থেকে উদ্ধার করেছে।

এক দশক ধরে সমুদ্রে শরণার্থী এবং অভিবাসীদের বাঁচাতে কাজ করা এই সংস্থাটি এক সতর্কবার্তা দিয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, সমুদ্র চলাচলের অনুপযোগী নৌকা অতিরিক্ত বোঝাই করে লিবিয়া বা তিউনিশিয়া থেকে ইউরোপে আসা সঙ্গীবিহীন শিশু এবং নাবালকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সংস্থাটির উদ্ধার করা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই নাবালক।

জার্মান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এস্থার ২০২৪ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার অভিযানে স্বেচ্ছাসেবী মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছিলেন।

বার্লিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এস্থার বলেন, সমুদ্রে এই উদ্ধার অভিযানে ৩৪৭ জনকে বহন করা ছয়টি নৌকা উদ্ধার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪৩ জন কিশোর ছিলেন। এদের বেশিরভাগ একা ভ্রমণ করছিলেন। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাও খারাপ ছিল।

এস্থার বলেন, ‘তারা প্রায়ই টানা কয়েক দিন এবং রাত খাবার বা পানীয় ছাড়াই সমুদ্রে ভাসছিলেন, পানিশূন্য অবস্থায় ছিলেন। (নৌকার) জ্বালানি ও লবণাক্ত জলের কারণে তাদের ত্বক পুড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে লিবিয়ার শিবিরে আটক থাকায় অনেকেরই চুলকানি বা অন্যান্য সংক্রমণ এবং ক্ষত ছিল। তারা সবাই মানসিকভাবে ক্লান্ত ছিলেন।’

লিবিয়ার শিবিরগুলোতে শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিতে

ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করার সময় উপকূলরক্ষী বাহিনীর হাতে আটক অভিবাসীদের লিবিয়ার আটককেন্দ্রে রাখা হয়। এই আটক শিবিরগুলোর পরিস্থিতি বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য বিপর্যয়কর।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কয়েক মিলিয়ন ইউরোর চুক্তির অধীনে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং অভিবাসী সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস করার উদ্দেশ্যে এসব আটককেন্দ্র তৈরি করেছে লিবিয়া। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে শিবিরগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তীব্র সমালোচনা রয়েছে।

এস্থার জানান, কিশোররা আমার কাছে চরম যৌন সহিংসতা, নির্যাতন, শিশুশ্রম, স্বজন হারানো এবং নারী পাচারের ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছে।

তিনি বলেন, এই কিশোরদের মধ্যে কয়েকজন আমাকে তাদের সঙ্গে ঘটা শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ দেখিয়েছে। কারো কারো শরীরে নির্যাতনের ক্ষত ছিল, কারো কাছে লিবিয়ার শিবিরে তাদের বেঁধে রাখা এবং মারধর করার ছবি এবং ভিডিও রয়েছে।

সাড়ে তিন হাজারের বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ক মৃত বা নিখোঁজ

শিবির থেকে পালিয়ে আসা অপ্রাপ্তবয়স্করা সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হন। এপ্রিলে দেওয়া ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে মধ্য ভূমধ্যসাগর রুট দিয়ে ইতালিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় প্রায় সাড়ে তিন হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে। অর্থাৎ, এক দশক ধরে প্রতিদিন গড়ে একজন শিশু মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে।

এই পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা উল্লেখ করে লিবিয়া এবং তিউনিশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে এসওএস হিউম্যানিটি।

এসওএস হিউম্যানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিল রুমেনহোল বলেন, গত ১০ বছর ধরে পালিয়ে আসাদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতালিতে আগতদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আমাদের উদ্ধার করাদের মধ্যে গড়ে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।

তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা একটি নৌকা উদ্ধার করেছি, যেটিতে থাকা ১২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। তারা সবাই সঙ্গীবিহীন আতঙ্কিত কিশোর-কিশোরী ছিল এবং লিবিয়ার উপকূলরক্ষীদের ভয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

ট্রাম্পের সহায়তা হ্রাসের নাটকীয় পরিণতি

ইউরোপের পথে বিপজ্জনক যাত্রায় আসা অপ্রাপ্তবয়স্কের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এসওএস চিলড্রেন’স ভিলেজ ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রধান লানা ইদ্রিস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সরকার উন্নয়ন সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি ভেঙে দেওয়ার ফলে পরিণতি আরো খারাপ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইউএসএআইডি এর সহায়তা কমে যাওয়ার ফলে আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী এক কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৫০ লাখ শিশুও রয়েছে। জার্মানিও তাদের উন্নয়ন সহায়তা প্রায় ১০০ কোটি ইউরো (এক ইউরো = ১৩০ টাকা প্রায়) কমিয়ে দিয়েছে।

সোমালিয়ার উদাহরণ তুলে ধরে ইদ্রিস বলেন, আমরা এমন এক দুষ্টচক্রের মধ্যে প্রবেশ করছি, যার ফলে আরও বেশি শিশু এই পথ বেছে নেবে। দেশটি ইউএসএআইডির ওপর ৮০ শতাংশ নির্ভরশীল ছিল। গত বছর আমরা সোমালিয়ায় ৪৫ লাখ শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর কাছে পৌঁছেছি, যা এই বছর মাত্র ১৩ লাখ। কেন? কারণ এই শিশুদের সহায়তার জন্য তৈরি ক্যাম্পগুলো গ্রীষ্মের পর থেকে খালি রয়েছে।

ফেরা মাগালি কেলার বার্লিনের একটি আইন সংস্থার প্রধান। এই সংস্থাটি সমুদ্রে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা সংস্থা এবং মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।

কেলার বলেন, বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে বসবাস, সুরক্ষার অধিকার এবং পারিবারিক পুনর্মিলনের অধিকার পাওয়ার জন্য বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইতালিতে এই আইনি সুরক্ষা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত প্রযোজ্য হয়। একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে, শিশু-কিশোরদের প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। তাদের আটক করার পরিস্থিতি এড়ানো উচিত।

তহবিল কমিয়েছে জার্মান সরকারও

২০২৬ সালে এসওএস হিউম্যানিটি ভূমধ্যসাগরে আরেকটি উদ্ধার জাহাজ মোতায়েনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। জাহাজটি মূলত তিউনিশিয়া উপকূলে কাজ করবে, অভিবাসী নৌকার সন্ধান চালাবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণ করবে।

এজন্য সংস্থাটি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জার্মান সরকার বেসামরিক সমুদ্র উদ্ধার সংস্থাগুলোকে বার্ষিক ২০ লাখ ইউরোর তহবিল বন্ধ করে দিয়েছে। কেলার মনে করেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হওয়ার এটিও একটি কারণ।

তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক এবং আইনি পরিস্থিতিতে আমি কোনো ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না। আমার আশঙ্কা, বর্তমান জোট সরকারের অধীনে বেসামরিক সমুদ্র উদ্ধারকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা এবং দমন করার ঘটনা তীব্রতর হবে। শরণার্থীদের জন্য ইউরোপে বিপর্যয়কর সুরক্ষা এবং অভ্যর্থনার মান সম্ভবত আরো খারাপ হতে থাকবে।

এমআরএম/জিকেএস

Read Entire Article