মাঠে অবিক্রিত ৮ লাখ টন লবণ, তবুও আমদানির তোড়জোড়!

2 weeks ago 17

শরৎ শেষে হেমন্তে এসে থেমেছে বৃষ্টি। বর্তমান এই আবহাওয়ায় শুরু হয়েছে লবণ চাষের তোড়জোড়। সূর্যের তাপে নোনাজলকে ‌‘সাদা সোনায়’ পরিণত করে দেশের চাহিদা পূরণ করা হবে। এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ হবে অর্ধলাখ চাষির। তবে, গত মৌসুমে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় খরচই ওঠেনি। ফলে এখনো মাঠে মজুত রয়েছে ৫-৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ।

সূত্র বলছে, লবণের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে মৌসুম শুরুর আগেই লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। তবে চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার কাজ করছে বলে জানিয়ছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।

বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা ও পটিয়া উপজেলার কিছু অংশ মিলিয়ে ৬৯ হাজার একর জমিতে ৪১ হাজারের বেশি চাষি লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। ২০২৪-২৫ মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। অর্জন হয় ২২ লাখ ৫১ হাজার টন, যা ৬৫ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নভেম্বরে শুরু হচ্ছে নতুন মৌসুম। শুরু হতে যাওয়া মৌসুমে লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লাখ ১৮ হাজার টন।

বৃটিশ পিরিয়ড থেকেই কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে চলে আসছে লবণচাষ। শুরুতে চাহিদার এক-চতুর্থাংশ আমদানির দরকার পড়লেও গত দুদশক ধরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু অংশ মিলে চাষ হওয়া লবণ দেশের চাহিদার শতভাগ মিটিয়ে আসছে। ফলে, শতভাগ উৎপাদিত দেশীয় পণ্য হিসেবে গর্বের পেশা ছিল লবণ চাষ। কিন্তু সেই লবণ চাষ গত অর্থবছর থেকেই বোঝা হয়ে উঠেছে। খরচ উঠে না আসায় নীরবে কাঁদছেন লবণচাষিরা।

ঈদগাঁওয়ের গোমাতলীর লবণচাষি রিদুয়ানুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিমণ লবণের দাম ১৮০-২০০ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে তিনশ টাকারও বেশি।’

তিনি বলেন, ‘তিন কানি জমিতে (প্রায় ১ দশমিক ২০ একর) চাষ করতে জমি ইজারা, পলিথিন, শ্রমিক মজুরি, লবণ মাঠ প্রস্তুতসহ খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। বিক্রির আয় দিয়ে সেই খরচও উঠছে না। লোকসানের বোঝা বইতে হচ্ছে সবাইকে। সেটি মাথায় থাকায় আসন্ন মৌসুমে মাঠে নামবো কি-না, এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।’

সম্প্রতি ‘লবণ উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদ’ মহেশখালীতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এসময় তারা তাদের উৎপাদিত লবণ সড়কে ফেলে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান। চাষিদের দাবি, বিদেশি লবণ আমদানি বন্ধ, লবণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ এবং দ্রুত জাতীয় লবণ বোর্ড গঠন করে শিল্পকে রক্ষা করতে হবে।

লবণ উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ লবণচাষিদের দুর্দশা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হলেও চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। একদিকে জমি ইজারার অস্বাভাবিক খরচ, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের অপ্রাপ্যতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে চাষিরা দিশেহারা।’

বিসিকের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বিসিক প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত চাষিদের চেয়ে শিল্প মালিক ও একটি মাফিয়া গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় বেশি সক্রিয়। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লবণচাষিদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। দেশে চাহিদা মেটানোর মতো লবণ উৎপাদন হচ্ছে। তাই বিদেশ থেকে আমদানির কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং সরকারের উচিত, চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার সুযোগ নিশ্চিত করা।’

আরও পড়ুন:
দেশে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করে ৭৬ শতাংশ মানুষ: বিসিক
টিসিবির কার্ডে মিলবে সাবান-চা-লবণ
শরীরের নীরব শত্রু লবণ
উৎপাদন খরচও উঠছে না লবণ চাষিদের
৬৪ বছরের ইতিহাস টপকে লবণের রেকর্ড উৎপাদন

চাষিদের দাবি, মাঠ ও গুদামে পড়ে আছে ৮-১০ লাখ মেট্রিক টন অবিক্রিত লবণ। অথচ বিসিকের হিসেবে মজুতের পরিমাণ মাত্র ৫ লাখ টন। এই গরমিলে প্রশ্ন উঠছে, চক্র বিশেষ পরিকল্পিতভাবে লবণ আমদানি করতে চাইছে কি-না।

বাংলাদেশ সল্টেড অ্যান্ড ডিহাইড্রেটেড ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল শুক্কুর বলেন, ‘নভেম্বরেই শুরু হবে নতুন মৌসুমের লবণ উৎপাদন। অথচ এ অবস্থায় এখনো মাঠ পর্যায়ে গর্ত ও গুদামে চাষিদের কাছে ৮-১০ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে। বাজারে দাম অত্যন্ত কম হওয়ায় চাষিরা লবণ বিক্রি করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে যদি সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে লবণ আমদানির অনুমতি দেয়, তাহলে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’

আব্দুল শুক্কুরের অভিযোগ, ঢাকায় কিছু অসাধু লবণ আমদানিকারক রয়েছেন, যারা কক্সবাজারের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বিসিককে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সচিবালয়ে বিভ্রান্তিকর জরিপ উপস্থাপন করে লবণ আমদানির অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘লবণ শিল্প শুধু একটি খাত নয়, এটি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অবলম্বন। লবণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে এ অঞ্চলের এক শ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা অসম্ভব হবে।’

যা বলছে বিসিক

বিসিক কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, দেশের লবণ উৎপাদন মৌসুম মূলত নভেম্বর থেকে শুরু হলেও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় অক্টোবর থেকেই মাঠে নামেন লবণচাষিরা। বর্তমানে কুতুবদিয়ায় কিছু চাষি মাঠ প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত। আশা করা যায়, কক্সবাজার উপকূলের অন্যান্য এলাকাগুলোতেও নভেম্বরের শুরুতে চাষিরা মাঠে নেমে পড়বেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে প্রতি মণ লবণ ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ মুহূর্তে মাঠে প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে।

লবণ আমদানি সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত জানিয়ে জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি রয়েছে, যারা সার্বিক দিক বিবেচনা করেই আমদানির প্রয়োজন আছে কি-না তা নির্ধারণ করেন।

মজুতের রিপোর্টে কোনো গরমিল নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘বিসিক মাঠ পর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তালিকা তৈরি করে কার কাছে কত লবণ রয়েছে, তা আমরা নির্ভুলভাবে নথিভুক্ত করি। আমাদের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের মতো লবণ মজুত রয়েছে। কেউ কেউ ৮-১০ লাখ মেট্রিক টনের কথা বলছেন, তবে সেই তথ্য সঠিক নয়। মজুতের রিপোর্টে কোনো গরমিল নেই। সরকার কাজ করছে চাষিদের স্বার্থ রক্ষায়।’

আমদানির ফলে চাষিরা লবণ উৎপাদনে আগ্রহ হারাতে পারেন কি-না—এমন প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, ‘হ্যাঁ, যদি এ সময় আমদানি করা হয়, তাহলে চাষিদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হবে। তারা মাঠে নামতে আগ্রহ হারাতে পারেন। তবে সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। বৈঠকগুলোতে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনায় আসছে, যাতে চাষিরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

এসআর/জেআইএম

Read Entire Article