দখল-দূষণে বিপর্যস্ত একসময়ের প্রমত্তা বারনই নদী। রাজশাহী নগরীর সমস্ত অপরিশোধিত ময়লা দুটি নালা হয়ে এ নদীতে মিশেছে। ক্রমাগত এই দূষণের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত এই নদীটি আজ নর্দমায় পরিণত হয়েছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলছেন, দশকের পর দশক ধরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অবহেলার কারণে নদীটি একটি বিষাক্ত নর্দমায় পরিণত হয়েছে, যা এর তীরবর্তী জনস্বাস্থ্য, কৃষি এবং আঞ্চলিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নগরীর সব ধরনের তরল বর্জ্য বারনই নদীতে নিষ্কাশনের জন্য ১৯৯৪ সালে দুটি খাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। নির্মাণ শেষে পরবর্তীতে ২০০৮ সালে খাল দুটি বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেই থেকে নগরীর অপরিশোধিত বাসা-বাড়ির পয়োনিষ্কাশন, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের ক্ষতিকর বর্জ্য দুটি খাল দিয়ে শহরের অদূরে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার নিকট নদীতে মিশে যাচ্ছে।
নওহাটা এলাকার নদী তীরবর্তী বাসিন্দা গৃহিণী রাখি দাস বলেন, সিটি করপোরেশন তরল বর্জ্য ফেলার আগে তারা এই নদীর পানি গোসল ও রান্নার কাজে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন নদীর পানি স্পর্শ করতেও ভয় পান।
সুধী চন্দ্র সরকার বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি এতটাই দুর্গন্ধ ছড়ায় যে আশপাশে থাকা অসহনীয় হয়ে ওঠে। দুর্গন্ধের কারণে আমরা শান্তিতে খেতে, ঘুমাতে বা কোনো কাজ করতে পারি না। পানি যখন খুব বেশি বিষাক্ত হয়ে যায়, তখন প্রায়ই মাছ মরে ভেসে ওঠে। তখন স্থানীয় লোকজন খালি হাতেই মাছ ধরে থাকে।
স্থানীয় বেসরকারি সামাজিক সংগঠন ‘বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠন’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোস্তফা বিজলী জানান, রাজশাহী ও নাটোর জেলার সাতটি উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ যাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের, তারা এই নদীর দূষিত পানির সংস্পর্শে এসে চর্মরোগে ভুগছেন। শুধুমাত্র আমাদের এলাকাতেই ৮০০’র বেশি মানুষ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
নওহাটা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার মিলন মাহমুদ বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চর্মরোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
মধুসূদনপুর এলাকার কৃষক সাইফুর রহমান বলেন, তারা এটা জানেন যে, এই নদীর পানি ব্যবহার করলে চর্মরোগ এবং মাটি ও ফসলের ক্ষতি হয়। তবুও বিকল্প উৎস না থাকায় তারা একরকম বাধ্য হয়েই এই পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করেন।
৫৫ বছর বয়সী জেলে চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, সিটি করপোরেশনের তরল বর্জ্য নদীতে আসার পর থেকে নদীতে মাছ ক্রমাগতভাবে কমছে। একসময় নদীটি মাছে ভরা ছিল। কিন্তু এখন আর সেরকম মাছ পাওয়া যায় না। মাছের অভাবে অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করেছে।

তিনি আরও বলেন, পানি বিষাক্ত হওয়ায় নদীর মাছও খাওয়া যায় না। যতই ভালো করে মাছ রান্না করেন না কেন, মাছে এক ধরনের দুর্গন্ধ থেকেই যায়।
আরও পড়ুন-
পৌরসভার ময়লার ভাগাড় নদী
বুড়িগঙ্গার শাখা নদী এখন ভাগাড়, দুর্ভোগে এলাকাবাসী
৪০০ বছরের হরিগঞ্জ খাল এখন সরু নালা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, নদী দূষণ মূলত গৃহস্থালির পয়োনিষ্কাশন, হাসপাতালের বর্জ্য এবং বিসিক এস্টেটের ভেতরের কারখানা থেকে নির্গত শিল্প বর্জ্য থেকে হচ্ছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্যে রোগজীবাণু এবং বায়োমেডিক্যাল দূষণকারী পদার্থ থাকে, যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তিনি জানান, বিসিক এলাকায় প্রায় ২০০টি কারখানা থাকলেও সেগুলোর কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই। ফলে শিল্পকারখানার দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে চলে যাচ্ছে। এমনকি যানবাহন মেরামতের দোকানগুলোর বর্জ্য নদী দূষণ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
প্রায় ২০ হাজার ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়ির গ্যারেজগুলো নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত ব্যাটারির অ্যাসিড ড্রেনে ফেলে দেয়, যা নালা হয়ে নদীতে মিশে যাচ্ছে। এছাড়াও একটি নালা সিটি পশুহাটের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে, যেখানে মৃত প্রাণী এবং জবাইয়ের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয়। সেটিও নদীর পানি দূষণে ভূমিকা রাখছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের সহযোগিতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বারনইয়ের পানি জৈবিকভাবে মৃত (বায়োলোজিক্যালি ডেড) হয়ে গেছে।
গবেষণা অনুযায়ী, জলজজীবন ধারণের জন্য কোনো স্থানের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে সর্বনিম্ন ৪.৫ মিলিগ্রাম থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে দক্ষিণ নওদাপাড়া থেকে সংগৃহীত বারনই নদীর পানির নমুনায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র ১.২ মিলিগ্রাম পাওয়া গেছে। এছাড়াও পানিতে কন্ডাকটিভিটি (পরিবাহিতা) এবং ক্ষারত্বের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে, যা অতিরিক্ত দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ এবং রাসায়নিক দূষণ নির্দেশ করে।
খালের পাশের কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা করে তাতে মারাত্মক পর্যায়ের সিসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম এবং জিংকের মতো ভারি ধাতুর উপস্থিতিও পেয়েছে গবেষক দল।
অধ্যাপক মিজানুর বলেন, এই ধাতুগুলো মাটি থেকে ফসলে এবং ধীরে ধীরে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি ক্যানসার এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি মূল্যায়ন ব্যবহার করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বারনই নদীর তীরবর্তী শিশুরা ক্রোমিয়াম এবং আর্সেনিক থেকে সৃষ্ট ক্যানসারজনিত এবং অ-ক্যানসারজনিত ঝুঁকির শিকার হচ্ছে।
গবেষণায় সতর্ক করে বলা হয়েছে, নদীর পানি নিয়মিত গোসল, সেচ বা মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করলে স্নায়বিক, কিডনি সংক্রান্ত এবং ক্যানসারজনিত বিভিন্ন রোগ হতে পারে।

পরিবেশ আইনজীবী ও অধিকার সংগঠনগুলোর মতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের এই কার্যক্রম বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর পরিপন্থি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, ‘পরিবেশ আইনে শিল্প ও পৌরসভার বর্জ্যকে বিপজ্জনক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে এবং তা অপসারণের আগে পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষতির সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ অধিদপ্তর অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার জন্য নগর কর্তৃপক্ষ, হাসপাতাল বা শিল্পগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
এ সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞরা একটি কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ, সমস্ত শিল্পে বর্জ্য শোধনাগারা স্থাপন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য চিকিৎসা সহায়তাসহ জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অধ্যাপক মিজানুর বলেন, ‘বারনই নদীর দূষণ শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়। বরং এটি একটি মানবাধিকার সংকট। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে, পুরো অঞ্চলের স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।’
এই সংকটের কথা স্বীকার করে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, তারা সম্প্রতি শহরের কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।
রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ বলেন, তারাও একটি কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য একটি প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) জমা দিয়েছেন। তবে এটি তৈরি করতে কতদিন লাগতে পারে তা উভয় কর্মকর্তাই জানাতে পারেননি।
এফএ/এমএস

2 weeks ago
5









English (US) ·