শ্রম সংস্কারে সুপারিশ ২৫ বাস্তবায়ন ৩

1 day ago 3
শ্রম সংস্কারে সুপারিশ ২৫ বাস্তবায়ন ৩

শ্রম সংস্কারে সুপারিশ ২৫ বাস্তবায়ন ৩

বাংলাদেশ

আবু হেনা মুহিব 2025-11-05

শ্রম খাত উন্নয়নে সংস্কার কমিশনের দেওয়া ২৫ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র তিনটি। তবে শ্রমিকদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণসহ মৌলিক সংস্কারের সুপারিশে এখনও নজর দেওয়া হয়নি। শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এসব সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। 

গত ১৭ নভেম্বর গঠন করা হয়েছিল ১০ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ কমিশনের নেতৃত্ব দেন। গত ২১ এপ্রিল কমিশন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৪৬০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। শ্রম খাত-সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কৃষক, পেশাজীবী সংগঠন, উদ্যোক্তা, মানবাধিকার সংগঠন, দেশি-বিদেশি সংস্থাসহ পঞ্চাশের মতো অংশীজনের মতামত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতি, গবেষণা এবং পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। 

গত সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত সংশোধিত শ্রম আইনে কমিশনের সুপারিশের আলোকে  তিনটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। এগুলো হলো– ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ করা, শ্রমিকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এবং শ্রমিকের বিরুদ্ধে করা ৪৭ হাজার ৭২৮টি মামলা প্রত্যাহার। এ ছাড়া শ্রম আইনে সংশোধনের বাইরে  রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আউট সোর্সিং শ্রমিকের জন্য জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। 

ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়াটি শ্রম খাতের মৌলিক ইস্যুর অন্যতম। দীর্ঘদিন ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং কার্যক্রম নিয়ে মালিক, শ্রমিক ও সরকার– এই তিন পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট চলছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহল থেকে ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা অবারিত নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিবেচনায়  শ্রমিকের সংগঠিত হওয়া এবং সম্মিলিত দরকষাকষির ক্ষেত্রে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা সহজ করার বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ ছিল। এ জন্য ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পর্ষদ (টিসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছিল কমিশন। 

কমিশনের এই সুপারিশের আলোকে  শ্রম আইন সংশোধনে টিসিসি গঠন করে সরকার। টিসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ট্রেড ইউনিয়ন প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। সংশোধিত শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে ২০ জন এক হলেই ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে। তবে এ রকম ক্ষেত্রে নিবন্ধনের সুযোগ থাকবে না। নিবন্ধনের জন্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংখ্যা ২০ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত হলে ২০ জনকে একত্রিত হতে হবে। ৩০১ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত ৪০ জন, ৫০১ জন থেকে এক হাজার ৫০০ জন পর্যন্ত ১০০ জন, এক হাজার ৫০১ জন থেকে তিন হাজার জন পর্যন্ত ৩০০ জন ও তিন হাজার একজনের যত বেশিই হোক, সে ক্ষেত্রে ৪০০ শ্রমিক এক হলেই ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যাবে। 

তবে এ নিয়ে শিল্পকারখানা মালিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, টিসিসির সর্বশেষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে শ্রমিকের অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর তৈরি পোশাক খাতের প্রধান সংগঠন বিজিএমইএর নেতৃত্বে সাতটি বাণিজ্য সংগঠনের যৌথ সংবাদ সম্মেলন থেকে সংশোধিত শ্রম আইনকে বাস্তবতাবিবর্জিত বলে আইনটি পুনর্বিবেচনার দাবি করেছে। শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন খাতের নিয়োগ কর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন (বিইএফ) আরও সংক্ষুব্ধ। 

ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান সমকালকে বলেন, এ ধরনের আইন করা অজ্ঞতাপ্রসূত। অভিজ্ঞতার অভাবের কারণেই এ ধরনের আইন করার কথা মাথায় আসতে পারে। সংশোধিত শ্রম আইনের কারণে শিল্পকারখানায় শ্রম অসন্তোষ বাড়বে।  তারা এখন বিধিমালা প্রণয়ন পর্যন্ত অপেক্ষায় আছেন। বিধিমালায় ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা এবং অন্য বিষয়গুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে আদালতের আশ্রয় নেওয়া হবে। শ্রম আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম ১০০ শ্রমিক এক হলেই শুধু ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন দেওয়ার শর্ত রাখতে শ্রম মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন দিয়েছিল বিইএফ। 
কমিশনের সুপারিশের আলোকে সংশোধিত শ্রম আইনে শিল্পকারখানায় শ্রমিকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ বিষয়েও আপত্তি আছে নিয়োগ কর্তাদের। এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, শ্রমিকের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক করে ফেলার কারণে অধিকার ভোগের বিষয়টিতে  জটিলতা তৈরি হবে। 

কমিশনের সুপারিশের আলোকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা ৪৭ হাজার ৭২৮টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে গত আগস্টে। পর্যালোচনার মাধ্যমে এসব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ ছিল কমিশনের। অবশ্য, গত বছর আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মামলাগুলো প্রত্যাহারের কার্যক্রম শুরু করে শ্রম মন্ত্রণালয়। 

শ্রম আইনে এই তিন সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত ছাড়া কমিশনের অন্য সুপারিশের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আউট সোর্সিং শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত করে একটি নীতিমালা করা হয়েছে, যা এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। 
শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, কমিশনের সব সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সংশোধিত শ্রম আইনে কিছু বিষয় এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই সব সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য করা সম্ভব নয়। সুপারিশের আলোকে করণীয় নির্ধারণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটা মিশ্র অবস্থা দেখছি। ইতোমধ্যে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে সরকার। সিলেটে চা শ্রমিক ভূমি অধিকারের বিষয়ে সিলেট জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন উপযোগী মজুরির অধিকার নিশ্চিতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ, মজুরি নির্ধারণে কাঠামোগত সংস্কারে স্থায়ী মজুরি কমিশন গঠনের মতো মৌলিক সংস্কারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। সরকার যাতে কমিশনের সব সুপারিশ আমলে নেয়, সে বিষয়ে শ্রমিক এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। 

 

 

 

© Samakal
Read Entire Article