সব বিভাগে হবে পুলিশের জবাবদিহিতা শাখা
বাংলাদেশ
সাহাদাত হোসেন পরশ 2025-11-05পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর প্রস্তাবিত খসড়া চূড়ান্ত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এতে নতুন বেশ কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে পুলিশ কমিশনের একটি কাঠামো রাখা হয়েছে। এর নাম থাকবে ‘জবাবদিহিতা ইউনিট’। এই ইউনিটের সদস্য থাকবেন তিনজন। জেলা জজ হবেন চেয়ারপারসন। চতুর্থ গ্রেডের একজন সরকারি কর্মকর্তা ও ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানবাধিকারকর্মী এই ইউনিটের সদস্য থাকবেন।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের জবাবদিহিতা তৃণমূল পর্যায়ে নিতে বিভাগীয় পর্যায়ে নতুন ইউনিট যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া থানায় কোনো ভুক্তভোগী সেবা না পেলে এসপি ও তাঁর চেয়ে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কাছে যাতে প্রতিকার চাইতে পারেন, তার একটি ব্যবস্থা রাখার কথা অধ্যাদেশের খসড়ায় রাখা হয়েছে।
সূত্র বলছে, প্রস্তাবিত খসড়ায় জবাবদিহিতা ইউনিটের কাছে সাধারণ নাগরিকের যে কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। আগে অভিযোগ নিষ্পত্তির সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না।
প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিশনকে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ধারা ১৪, ১৫ ও ১৬-এর অধীন অনুসন্ধান বা তদন্তের স্বার্থে পুলিশ জবাবদিহিতা ইউনিট যে কোনো অভিযোগকারীকে সুরক্ষা দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে। কোনো অভিযোগকারীকে ভয় ও হুমকি প্রদান করলে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের যে কোনো ব্যাপারে আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার থাকবে এই ইউনিটের।
সূত্র বলছে, এক সপ্তাহের মধ্যে অধ্যাদেশের খসড়াটি সচিব কমিটির মাধ্যমে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের জন্য যাবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজপি) নিয়োগের সুপারিশ করবে কমিশন। কমিশনের সুপারিশ অনুসারে মহাপুলিশ পরিদর্শক পদে নিয়োগ প্রদান করবেন রাষ্ট্রপতি। সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা ও সন্তোষজনক দায়িত্ব পালনের ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শকের নিম্নপদস্থ নন– এমন তিনজন কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্যানেল রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ আকারে পাঠানো হবে। কমিশনের পাঠানো তালিকা থেকে একজন আইজপি পদে নিয়োগ পাবেন। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাভাবিক অবসরের নির্ধারিত তারিখ যেটা হোক না কেন, মহাপুলিশ পরিদর্শক পদে তাঁর কর্মকাল নিয়োগের তারিখ থেকে দুই বছর হবে।
পুলিশ কমিশনের খসড়ায় আরও বলা হয়, পুলিশ পরিদর্শকের মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই মাস আগে কমিশন পরবর্তী পুলিশপ্রধান বাছাইয়ের কাজ শুরু করবেন। এক মাস আগে রাষ্ট্রপতির কাছে পরবর্তী সম্ভাব্য তিনজনের নাম পাঠাবেন। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো পুলিশ মহাপরিদর্শক বরখাস্ত, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে পদ শূন্য হলে কমিশন পরবর্তী এক মাসের মধ্যে প্যানেল প্রস্তুত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে।
প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, সাত সদস্যের একটি কমিটি কমিশনের সদস্য বাছাইয়ের জন্য নাম সুপারিশ করবে। আগের খসড়ায় বাছাই কমিটি ছিল পাঁচ সদস্যের। বর্তমানে যে সাতজন বাছাই কমিটিতে থাকবেন তারা হলেন– প্রধান বিচারপতির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মনোনীত একজন সরকারদলীয় ও একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত মানবাধিকার রক্ষণ বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন নাগরিক প্রতিনিধি। ন্যূনতম জন সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়, যদি সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় থাকে, সে ক্ষেত্রে চারজন সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম গঠিত হবে। পুলিশ কমিশনের প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সাত সদস্যের কমিশনে আরও থাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড-২ পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। এ ছাড়া অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া পুলিশ একাডেমির একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অথবা পুলিশ স্টাফ কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত রেক্টর কমিশনের সদস্য থাকবেন। আইন, অপরাধবিজ্ঞান বা পুলিশবিজ্ঞান বিষয়ের একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং মানবাধিকার উন্নয়ন বা বাস্তবায়নে কিংবা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানবাধিকারকর্মী থাকবেন।
প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়, কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকবে। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে দুইজন নারী থাকবেন। কমিশনের চেয়ারপারসনের পদ শূন্য হলে বা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা এমনকি অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, শূন্য পদে নবনিযুক্ত কেউ না আসা পর্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে দেউলিয়া বা ঋণখেলাপি ঘোষিত হলে কমিশনের সদস্য হওয়া যাবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের নাগরিক নন বা অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন এমন কেউ কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় বা সরকারি মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থায়, এমনকি সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক অংশ বা স্বার্থ আছে এমন কোনো সংস্থায় চাকরিরত কেউ কমিশনের সদস্য হতে পারবেন না।
দুর্নীতি বা অন্য কোনো অসদাচরণের কারণে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত, অপসারিত বা বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত হলে কমিশনের সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফৌজদারি অপরাধে কারাদণ্ড ভোগ করলে বা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে কমিশনের সদস্য বলে বিবেচনায় আসবে না।
কমিশনের কার্যক্রমের মধ্যে থাকবে পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা ও উৎকর্ষ আনয়ন, শৃঙ্খলা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। নিয়মিত পরিবীক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের সততা, শৃঙ্খলা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধ সুরক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসারে পুলিশি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ। পুলিশ বাহিনীতে আধুনিক প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, ট্রাফিক ও সড়ক নিরাপত্তা, ফরেনসিক ও ডেটা ব্যবস্থাপনা সংযুক্তীকরণে পরিবীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় নীতিনির্দেশনা বা সুপারিশ প্রদান। সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ তদন্ত ও প্রসিকিউশন কার্যক্রমে বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও উত্তরণে প্রয়োজনীয় নীতিনির্দেশনা বা সুপারিশ করা।
আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও বলপ্রয়োগ-সংক্রান্ত কাজে মানবাধিকার রক্ষায় প্রশিক্ষণ প্রদান, যুক্তির ব্যবহারে দিকনির্দেশনা প্রদান ও এ-সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশি কার্যক্রমের নিয়মিত নিরীক্ষা। পুলিশের আইনানুগ কার্যক্রমে কোনো ব্যক্তি বা সত্তা বিধিবহির্ভূত বা অযাচিত প্রভাব বিস্তার করলে, তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ বা সুপারিশ করা। জনগণ ও পুলিশের পারস্পরিক আস্থা বাড়ানোর নিমিত্ত গণশুনানি, পরামর্শ সভা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম আয়োজন।
পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসনে একটি কমিটি থাকবে। বিধিবহির্ভূত প্রভাব, পদোন্নতি, পদায়ন, বিভাগীয় শাস্তি প্রদানে বৈষম্য ও অনিয়ম, অবৈধ নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধ্যকরণ, হয়রানি, বঞ্চনা বা অন্যায্য আচরণ-সংক্রান্ত সংক্ষোভ নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেবে কমিশন। পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। সংক্ষোভ নিরসন-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা বা সুপারিশ প্রদান করবে। নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও পরামর্শ দেবে কমিশন।
© Samakal

1 day ago
2









English (US) ·