কয়েক মাস আগে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি প্লেন বিধ্বস্তের ঘটনায় ২৪১ আরোহীর মৃত্যু হয়। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন মাত্র একজন। তার নাম বিশোয়াস কুমার রমেশ। এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নিজেকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি’ হিসেবে মনে করেন। যদিও তীব্র শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা এখনো পিছু ছাড়েনি তার।
গুজরাটের আহমেদাবাদে চলতি বছরের জুন মাসে বিধ্বস্ত হয় লন্ডনগামী প্লেনটি। বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত বেরিয়ে আসা বিশোয়াস কুমার রমেশের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি।
এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় একমাত্র জীবিত যাত্রী বিবিসিকে বলেছেন, বেঁচে যাওয়াটা নিতান্তই অলৌকিক ছিল। একইসঙ্গে এও জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় নিজে বেঁচে ফিরলেও কীভাবে সবকিছু হারিয়েছেন তিনি।
এয়ার ইন্ডিয়ার ওই প্লেনে তার ছোট ভাই অজয়ও ছিলেন। কিছুটা দূরের আসনে বসা ছোট ভাই রেহাই পাননি। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল তার ভাই অজয়ের।
পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডের লেস্টারে ফেরার পর থেকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর সঙ্গে লড়ছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। স্ত্রী এবং চার বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না তিনি।
গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় বোয়িং ৭৮৭। ঘটনার পর পরই প্রকাশ্যে আসা এক ভিডিওতে দেখা যায় বিধ্বস্ত হওয়া ওই প্লেনের ধ্বংসাবশেষ থেকে হেঁটে বেরিয়ে আসছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। তার পেছনে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া।
অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়
বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বেশ কয়েকবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। তিনি বলেন, একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। আমি এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারি না। এটা কোনো অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়।
আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি। ভাই ছিল আমার শক্তি। গত কয়েক বছর ধরে সেই ছিল আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্টার। এই ঘটনা কীভাবে তার এবং তার পরিবারের জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়েছে, তা জানিয়েছেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক।
তার কথায়, এখন আমি একা। নিজের রুমে চুপচাপ একলা বসে থাকি। আমি আমার স্ত্রী বা ছেলের সঙ্গে কথা বলি না। আমি এখন একা থাকতেই পছন্দ করি।
হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থা থেকে তিনি বর্ণনা করেছিলেন ঘটনার দিন কীভাবে নিজের সিটবেল্ট খুলে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডনগামী বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় যাত্রী এবং বিমানের ক্র্যু মিলিয়ে ১৬৯ জন ভারতীয় এবং ৫২ জন ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। ওই প্লেনটি ভেঙে পড়ে ঘটনাস্থল ও সে সময় তার কাছাকাছি থাকা ১৯ জনেরও প্রাণ কেড়েছিল।
চলতি মাসের জুলাই মাসে ভারতের ‘এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (এসিআইবি) তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানের ইঞ্জিনের জ্বালানি সরবরাহ কাট-অফ (সুইচ) হয়ে গিয়েছিল। এখনো ঘটনার তদন্ত চলছে।
এদিকে, এয়ার ইন্ডিয়া বলছে, বিশোয়াস কুমার রমেশ এবং এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারের খেয়াল রাখার বিষয়টি তাদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। ঘটনার দিনের কথা জানতে চাইলে রমেস বলেন, আমি এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।
ঘটনার পর তার এবং তার পরিবার যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, এই দুর্ঘটনার পর…আমার জন্য পরিস্থিতি খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে।
শারীরিক ও মানসিকভাবে আমার জীবন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমার পরিবারও মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত… আমার মা গত চার মাস ধরে প্রতিদিন দরজার বাইরে বসে থাকেন, কারও সঙ্গে কথা বলেন না… কিচ্ছু না।
নিজের মানসিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বিশোয়াস কুমার রমেশ বলেন, আমিও কারও সঙ্গে কথা বলি না। কারও কথা সঙ্গে বলতে ইচ্ছেও করে না। তিনিই দুর্ঘটনায় একমাত্র বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি এর বাইরে আর বেশি কিছু বলতে পারছেন না তিনি। রমেশ বলেন, সারারাত ভাবতে থাকি নিয়ে, মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমি।
প্রতিটা দিনই আমার পুরো পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক, আমি ঠিকমতো হাঁটতেও পারি না। ওই ঘটনায় তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে জানিয়েছেন রমেশ। তিনি জানিয়েছেন তার আসন ১১-এ থেকে বিমানের ভাঙা অংশ দিয়ে কোনোমতে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, আমার পা, কাঁধ, হাঁটু ও পিঠে এখনো ব্যথা হয়। দুর্ঘটনার পর থেকে আমি কাজ করতে পারছি না, গাড়ি চালাতেও পারছি না। যখন আমি চলার চেষ্টা করি তখন ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। আমি আস্তে আস্তে হাঁটি, আমাকে আমার স্ত্রী (চলতে) সাহায্য করেন।
ভারতে চিকিৎসা চলাকালীন চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন, বিশোয়াস কুমার রমেশ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর সঙ্গে লড়ছেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর থেকে তিনি কোনো চিকিৎসা পাননি বলে জানিয়েছেন রমেশের পরামর্শদাতারা।
তারা জানিয়েছেন, ঘটনার পর একেবারে ভেঙে পড়েছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। সেরে ওঠার জন্য তাকে পথ দীর্ঘ চলতে হবে। পরামর্শদাতাদের অভিযোগ, ঘটনার পর এয়ার ইন্ডিয়া তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। তাই তারা ওই বিমান সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের দাবি জানিয়েছেন।
কমিউনিটি নেতা সঞ্জীব প্যাটেল বিবিসিকে বলেছেন, ওরা মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। এই ঘটনা ওদের পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের এগিয়ে আসতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তাদের কী প্রয়োজন বুঝতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে।
এয়ার ইন্ডিয়া বিশোয়াস কুমার রমেশকে অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২১ হাজার ৫০০ পাউন্ড (ভারতীয় টাকার হিসাবে প্রায় ২৫ লাখ টাকা) দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা তিনি গ্রহণ করেছেন। তবে তার পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন যে, অঙ্কটা তার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
তারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার আগে বিশোয়াস কুমার ও তার ভাই অজয় ভারতের দিউতে মাছের ব্যবসা চালাতেন, যা এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
পরিবারের মুখপাত্র রাড সিগার জানিয়েছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে বৈঠকের জন্য তারা তিনবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তাদের হয় উপেক্ষা করা হয়েছিল বা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমে এই সাক্ষাৎকারগুলোর মাধ্যমে তারা আসলে চতুর্থবার এয়ারলাইন্সের কাছে আবেদন জানাতে চান।
তবে টাটা গ্রুপের মালিকানাধীন এয়ার ইন্ডিয়া অবশ্য এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করছেন এবং গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশোয়াস কুমার রমেশের প্রতিনিধিদের কাছেও এই জাতীয় বৈঠকের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব এবং ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার আশা রাখব। এয়ার ইন্ডিয়া বিবিসিকে জানিয়েছে, সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগেই তাদের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিটিএন

13 hours ago
7









English (US) ·