সুদিন ফিরেছে সমতলের চা চাষে, দামে খুশি চাষিরা

1 week ago 11
  • ১২ টাকা কেজির চা পাতার দাম এখন ৩৫ টাকা
  • চায়ের গুণগত মান বৃদ্ধিতে দাম পাচ্ছেন কারখানা মালিকরাও
  • সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার চেয়ে দাম কম হওয়ায় আগ্রহী বায়াররা

জেলা প্রশাসন, স্থানীয় চা বোর্ডের নীতি নির্ধারণসহ কড়া তদারকি এবং কারখানা মালিক ও চাষিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুদিন ফিরেছে পঞ্চগড়ের সমতলের চা চাষে। চায়ের গুণগত মান বৃদ্ধির ফলে নিলাম মার্কেটে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে উপযুক্ত দামেই কাঁচা চা পাতা কিনছেন কারখানা মালিকরা। উন্নত মানের কাঁচা পাতা সরবরাহের ফলে কারখানা মালিকরাও ভালো মানের চা তৈরি করতে পেরে খুশি। সর্বপরী গত কয়েক মৌসুমে লোকসানের পর চলতি চা মৌসুমে উপযুক্ত দাম পেয়ে খুশি চা চাষিরা।

দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পঞ্চগড়ের সমতলে চায়ে কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনছিলেন চা চাষিরা। মাত্র ১২ টাকা কেজি দরে কাঁচা পাতা বিক্রি এবং ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্য কর্তন করেও ক্ষুদ্র চা চাষিদের পাওনা টাকার জন্য ঘুরতে হতো দিনের পর দিন। লোকসানের মুখে অনেক চা চাষি সেচ প্রদানসহ চা বাগানের পরিচর্যা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ তুলে ফেলেছিলেন শখের চা বাগান। বর্তমানে ভালো মানের কাঁচা পাতা ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজিতে কিনছেন কারখানা মালিকরা। এতে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সমতলের চা চাষিরা।

‘১২ টাকা কেজিতে পাতা বিক্রি করে বাগান পরিচর্যার টাকাও আসতো না। এজন্য বাগানে সেচ, কীটনাশকসহ পরিচর্যা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এ বছর ৩২ টাকা কেজিতে এখানকার চাষিরা পাতা বিক্রি করছেন। আমি আবারো বাগান পরিচর্যা শুরু করেছি।’

আঞ্চলিক চা বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সমতল জমিতে চায়ের সম্ভাবনা বুঝে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলাম প্রথম টবে কয়েকটি চা চারা লাগান। এরপর ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে এখানকার সমতল জমিতে চায়ের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০০০ সালে তেঁতুলিয়া চা কাজী অ্যান্ড কাজী প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। এরপর স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিনিয়োগকারী এসে তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলকায় পরিত্যক্ত জমি নিয়ে চা চাষ শুরু করেন। স্থানীয় ক্ষুদ্র চাষিরাও ধীরে ধীরে চা চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একটা সময় চায়ের সবুজে ভরে ওঠে উত্তরের এই প্রান্তিক জনপদ।

বর্তমানে জেলায় নয় হাজার ৭২৯ দশমিক ৭৩০ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। গেলো চা মৌসুমে উত্তরের সমতলে এক কোটি ৯২ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৩০টি কারখানায় এক কোটি ৩৮ লাখ কেজি চা উৎপাদন করা হয়েছে। আগামী এক-দেড় মাসে মৌসুমের শেষ পর্যন্ত এক কোটি ৫২ লাখ কেজি চা উৎপাদনের আশা চা বোর্ডের।

আরও পড়ুন
চায়ের ইতিহাসে লুকিয়ে আছে শ্রমিকের নীরব কষ্ট 
শ্রমিকদের জীবনচক্র আটকে আছে চা বাগানের গণ্ডিতে 
খরায় পুড়ছে চা বাগান 

উপজেলা সদরের মৌলবীপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র চা চাষি আমিনুর রহমান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে টানা কাঁচা চা পাতার উপযুক্ত দাম না পেয়ে চা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল চাষিরা। ক্ষুদ্র চা চাষিরা বাগানের যত্ন পর্যন্ত নিচ্ছিল না। অযত্ন আর অবহেলায় অনেক চা বাগান নষ্টের পথে। কেউ কেউ বাগান কেটে তুলে ফেলছিল। তখন ১২ টাকা কেজিতে কাঁচা পাতা বিক্রি করতে হতো। সেখান থেকে আবার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ওজন কর্তন করা হতো। পাওয়া টাকার জন্য কারখানা মালিকদের কাছেও ধরনা দিতে হতো। মাসের পর মাস ঘুরে টাকা পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্তমানে ভালো মানের পাতা সরবরাহ করলে কেজি প্রতি ৩২ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত দাম দিচ্ছেন কারখানা মালিকরা। এমন দাম পেলে এলাকায় চা চাষ আরও সম্প্রসারিত হবে।’

‘সরকারি কিছু পলিসিগত পরিবর্তন এসেছে। অকশন মার্কেটে এখানকার চায়ের জন্য দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭০ টাকা এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার চায়ের জন্য দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪৫ টাকা। দামের পার্থক্যের কারণে বায়াররা (ক্রেতা) উত্তরের চায়ের দিকেই ঝুঁকছে বেশি। মূলত অকশন মার্কেটে ভালো দাম পাওয়ায় আমরাও চা চাষিদের কাঁচা পাতার যথাযথ মূল্য দিতে পারছি।’

তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকার ক্ষুদ্র চা চাষি আরমান আলী বলেন, ‘চার একর জমিতে চা চাষ করি। প্রথম দিকে ভালোই দাম ছিল। কিন্তু গত ক’বছর ধরে টাকা লোকসান হচ্ছিল। ১২ টাকা কেজিতে পাতা বিক্রি করে বাগান পরিচর্যার টাকাও আসতো না। এজন্য বাগানে সেচ, কীটনাশকসহ পরিচর্যা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এবছর ৩২ টাকা কেজিতে এখানকার চাষিরা পাতা বিক্রি করছেন। আমি আবারো বাগান পরিচর্যা শুরু করেছি।’

নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার মাসুদ খান বলেন, ‘পঞ্চগড়ে চায়ের মান নিয়ন্ত্রণ এবং ভালো পাতা সরবরাহে আমরা সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আমরা কারখানার বাইরে ৩৫ টাকা কেজিতে গুণগত মানসম্পন্ন পাতা ক্রয়ের ব্যানার লাগিয়েছি। এখন পর্যাপ্ত পরিমাণ ভালো পাতা সরবরাহে সাড়া পাচ্ছি। ৩২ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত কেজি প্রতি দেওয়া হচ্ছে। উপযুক্ত দাম পেয়ে তারা বেশ খুশি। যারা এখনও ভালো মানের পাতা দিচ্ছেন না, তাদের মান বৃদ্ধিতে আমরা উদ্বুদ্ধ করছি।’

সুদিন ফিরেছে সমতলের চা চাষে, দামে খুশি চাষিরা

সাজেদা-রফিক চা কারখানার পরিচালক মো. আসাদুজ্জমান বলেন, ‘সরকারি কিছু পলিসিগত পরিবর্তন এসেছে। অকশন মার্কেটে এখানকার চায়ের জন্য দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭০ টাকা এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার চায়ের জন্য দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪৫ টাকা। দামের পার্থক্যের কারণে বায়াররা (ক্রেতা) উত্তরের চায়ের দিকেই ঝুঁকছে বেশি। মূলত অকশন মার্কেটে ভালো দাম পাওয়ায় আমরাও চা চাষিদের কাঁচা পাতার যথাযথ মূল্য দিতে পারছি।’

বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আরিফ খান বলেন, ‘বর্তমানে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে চা চাষিরা বিক্রি করছেন, এটার নেপথ্যে কিছু কারণ আছে। আমি গত বছর যোগদানের আগে থেকে জেলা প্রশাসক মহোদয় চা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। আমি এসে অনেকগুলো টেকনিকাল বিষয় নিয়ে তার কাজের হাল ধরি। আসলে কারখানা মালিক, অকশন মার্কেট, চা চাষিদের চা উৎপাদনসহ সকল বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং প্রশাসনের কড়া তদারকির কারণে এখানকার চায়ের মান এখন অনেক উন্নত। এজন্য কারখানা মালিকরা অকশন মার্কেটে ভালো দাম পেয়ে খুশি। আর চা চাষিরাও কারখানা মালকিদের কাছ থেকে উপযুক্ত দাম পেয়ে খুশি।’

সুদিন ফিরেছে সমতলের চা চাষে, দামে খুশি চাষিরা

জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী বলেন, ‘গত বছর পঞ্চগড়ে যোগদানের দিনই চায়ের মূল্য নিয়ে ক্ষুদ্র চাষিদের ক্ষোভ দেখেছি। তখন চাষিদের ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজিতে চা বিক্রি করতে হচ্ছিল। সেখান থেকে আবার নানা অজুহাতে ৩০/৪০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন কর্তন করা হচ্ছিল। এ নিয়ে চাষিদের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। এরপর থেকে এখানকার চা নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করি। চা বোর্ডসহ চা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ৩০টির বেশি মিটিং করেছি। অবশেষে চায়ের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে এবং উন্নতমানের চা উৎপাদনে কারখানা মালিক ও চা চাষিদের ১৪ দফা নীতিমালা দেওয়া হয়। পাশাপাশি কড়া মনিটরিংয়ের ফলে কাঁচা পাতা এবং তৈরিকৃত চায়ের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। আর অকশন মার্কেটে ভালো দাম পেয়ে এখানকার ক্ষুদ্র চা চাষিদের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হয়েছে।’

এফএ/জিকেএস

Read Entire Article