স্ট্রোকের মৃত্যঝুঁকি কমায় মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি

5 days ago 10

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু

আমাদের দেশের অনেক মানুষ এখনো মনে করেন, স্ট্রোক মানেই পঙ্গুত্ব। কিন্তু সময় পাল্টেছে, স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব।

স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসার অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হলো আইভি থ্রোম্বোলাইসিস। এটাকে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্তপিণ্ড জমাট বাঁধলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। এমন হলে মস্তিষ্কের অংশবিশেষ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের ওই অংশ কার্যক্ষমতা হারায়। এটাই ইস্কেমিক স্ট্রোক।

তবে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে জমাট বাধা রক্তপিণ্ডকে ওষুধের মাধ্যমে গলিয়ে দেয়া যায়। এতে করে বন্ধ রক্তনালী আবার চালু হয়। ফলে মস্তিষ্কের মৃতপ্রায় কোষগুলো রক্ষা পায়। স্ট্রোকের তীব্রতা কম হয়। ধমনীতে দেওয়া এই ওষুধটির নাম এল্টিপ্লেজ বা টেনেকটিপ্লেজ। এ ওষুধই জমাট বাধা রক্তপিণ্ডকে গলিয়ে দেয়।

সাধারণত স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগী হাসপাতালে আসলে এ চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব। তবে দেশের সব হাসপাতালে এ চিকিৎসা পাওয়া যায় না। রক্তপিণ্ড যদি ছোট রক্তনালীতে জমে, তবে আইভি থ্রোম্বোলাইসিসের মাধ্যমে তা গলিয়ে দেওয়া সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হলো স্ট্রোকে আক্রান্ত কেউ যদি সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আসতে না পারে অথবা হাসপাতালে আসলেও যদি দেখা যায় বড় ধরনের রক্তনালীতে রক্তপিণ্ড জমাট বেঁধেছে তাহলে কি স্ট্রোকের চিকিৎসা নাই?

যদি এককথায় বলি তাহলে বলব - অবশ্যই চিকিৎসা আছে। এমন কোন সমস্যা নাই যেটার জন্য স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা নাই। কোন রোগী যদি সাড়ে ৪ ঘণ্টার পরে আসে, বড় ধরণের রক্তনালীতে রক্তপিণ্ড জমা হলে বা কোন কারণে রোগীকে আইভি থ্রোম্বোলাইসিস করা সম্ভব না হলে তাকে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমির চিকিৎসা দেয়া যায়। এটি স্ট্রোকের একেবারে আধুনিক চিকিৎসা।

মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি কি?

এটা স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা। এটা ছোটখাটো একটা অপারেশন। ক্যাথল্যাবে করা হয়। হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীকে যেমন ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে বন্ধ রক্তনালীতে স্ট্যান্ট বসিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা হয় তেমনিভাবে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা হয়।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে কুচকির রক্তনালীতে ক্যানোলা পরানো হয়। একে বলে শিথ। এ শিথ মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রাখা হয়। এরপর মোটা ক্যাথেটার যে রক্তনালী বন্ধ হয়েছে তার গোড়ায় রাখা হয়। সাকশন মেশিনের সাহায্যে রক্তপিণ্ড টেনে বের করা হয়। এতে সফল না হলে একধরণের স্ট্যান্ট সুক্ষ্ম ক্যাথেটারের মধ্যে দিয়ে রক্তপিণ্ড পার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশেষ স্ট্যান্ট নিয়ে গিয়ে রক্তপিণ্ডের মধ্যে বসানো হয়। ৩-৫ মিনিট পর স্ট্যান্ট বের করে আনা হয়। স্ট্যান্টের ফাঁকা জায়গায় রক্তপিণ্ড আটকে যায়। ফলে বন্ধ হওয়া রক্তনালী খুলে যায়। রক্ত চলাচল আবার স্বাভাবিক হয়।

মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি কীভাবে কাজ করে?

কোন রক্তনালী যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন মস্তিষ্কের যে অংশ ওই রক্তনালী দ্বারা রক্ত পায় তা নষ্ট হয়ে যায়। একে বলে কোর। এ কোষগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এদের আর কর্মক্ষমতা থাকে না। কিন্তু নষ্ট হওয়া কোষগুলোর চারপাশে বেশ বড় জায়গা থাকে যেখানে রক্ত চলাচল কমে যায় কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় না। একে বলে পেনামব্রা। বন্ধ হওয়া এ রক্তনালী যত দ্রুত খুলে দেয়া যায় পেনামব্রাতে অবস্থিত কোষগুলো সতেজ হয়ে যায়। আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে।

কিন্তু রক্তনালী দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকলে পেনামব্রাতে অবস্থিত কোষগুলোর মৃত্যু ঘটে। একারণে দেখা দেয় পঙ্গুত্ব। মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমির মাধ্যমে বন্ধ হওয়া রক্তনালী খুলে দিতে পারলে মস্তিষ্কের বড় একটা অংশ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। এজন্য বলা হয় স্ট্রোকের প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ।

স্ট্রোকের কতক্ষণ পর্যন্ত মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা যায়?

বর্তমানে স্ট্রোকের কতক্ষণের মধ্যে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা যাবে তা নিয়ে বিভিন্ন গাইডলাইন বিভিন্ন মতামত দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ২০০৪ সালে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমির জন্য স্ট্যান্ট এফডিএ এপ্রুভাল পায়। এরপর থেকে উন্নত বিশ্বে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি স্ট্রোকের জনপ্রিয় চিকিৎসা হিসেবে পরিচিত পায়।

তখন স্ট্রোকের ৬ ঘণ্টার মধ্যে সম্ভব হলে এ চিকিৎসা প্রদান করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকজন গবেষক ৬ ঘণ্টার পরও মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি স্ট্রোকের চিকিৎসা হিসেবে প্রদান করেন। ৫ টি বিখ্যাত গবেষণায় প্রমানিত হয় যে, স্ট্রোকের চিকিৎসায় ১৬-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে স্ট্রোকের চিকিৎসায় আর সময়ের বাঁধা নাই।

দেশে কি সম্ভব?

দেশে স্ট্রোকের চিকিৎসা হিসেবে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি বহুল প্রচলিত হয় নাই। এটি এখন পর্যন্ত সহজলভ্যও নয়। আবার মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করতে পারে এমন জনবলেরও ঘাটতি আছে। তারপরও দেশের তরুণ একদল ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজিস্ট স্ট্রোকের চিকিৎসা হিসেবে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

দেশে একমাত্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে (নিনস) মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি প্রতিনিয়ত হচ্ছে। বেসরকারিভাবে হয় না বললেই চলে। তারপরও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ, কল্যাণপুরে এ চিকিৎসা অল্পবিস্তর হচ্ছে।

দেশে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি জনপ্রিয় করার উপায় কি?

দেশের মানুষ এখনো জানেন না স্ট্রোকের চিকিৎসা আছে। তারা মনে করেন স্ট্রোকের চিকিৎসা নাই। স্ট্রোক মানেই পঙ্গুত্ব বরণ। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী যত কারণে মৃত্যু হয় তার মধ্যে দ্বিতীয় কারণ স্ট্রোক। এজন্য স্ট্রোক প্রতিরোধে ও স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসায় সরকারের অংশগ্রহণ জরুরি। একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা হতে পারেন। কিন্তু স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা গেলে তিনি দেশের উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারেন।

যেহেতু মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমির চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল। তাই সরকারিভাবে এ চিকিৎসায় ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা ঢাকা কেন্দ্রিক। এটিকে বিভাগীয় শহরগুলোতে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমির চিকিৎসায় ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কেমন?

মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা হয় বড় রক্তনালী বন্ধ হলে। এ ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুহার বেশি। তাদের প্রায় ২০-৪০ শতাংশ মৃত্যু বরণ করেন। তাদের পঙ্গুত্বের হারও বেশি। কিন্তু যদি মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি সফলভাবে করা সম্ভব হয়, তাহলে মৃত্যুহার কমে যাবে। পঙ্গুত্বের হারও কমে যাবে।

গবেষণায় দেখা গেছে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা ব্যক্তিদের প্রায় ৫০ শতাংশ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন! মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা রোগীর মৃত্যুহার মাত্র ১০ শতাংশ।

কাজেই কেউ স্ট্রোক আক্রান্ত হলে আধুনিক চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হলে অবশ্যই নিতে হবে।

লেখক পরিচয়: ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু
সহকারী অধ্যাপক, স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল (নিনস)

এএমপি/এএসএম

Read Entire Article