রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালসহ পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবার মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে এসব হাসপাতালে এখন কেবল ‘নামমাত্র চিকিৎসা’ চলছে। আল্ট্রাসাউন্ড থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ কনসালটেন্ট পদগুলো শূন্য থাকায় রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। আবার রোগ একটু জটিল হলেই ফরিদপুর, কুষ্টিয়া অথবা ঢাকায় রেফার্ড করা হয় রোগীদের।এতে ভোগান্তি বাড়ার পাশাপাশি প্রাণহানির ঝুঁকিও বাড়ছে বহুগুণে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালসহ গোয়ালন্দ, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালীর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিশেষায়িত চিকিৎসকের তীব্র সংকট রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জেলার কোনো হাসপাতালেই চক্ষু রোগের চিকিৎসক নেই। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি হাসপাতালেই মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি, ডেন্টাল, চর্ম ও যৌন, গাইনি, অ্যানেস্থেশিয়া, ইএনটির মতো গুরুত্বপূর্ণ রোগের চিকিৎসক পদগুলো শূন্য রয়েছে।
রাজবাড়ী সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ২২ জন চিকিৎসক পদায়ন থাকলেও তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সংযুক্তিতে রয়েছেন। এই কারণে পদগুলো শূন্য দেখাচ্ছে না এবং নতুন ডাক্তারও পাওয়া যাচ্ছে না।
জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১০০ শয্যাবিশিষ্ট রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালটি জেলার ১২ থেকে ১৪ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র ভরসা। কিন্তু এখানে ভয়াবহ চিকিৎসক সংকট বিদ্যমান। তত্ত্বাবধায়কসহ ৪৩টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে বর্তমানে মাত্র ২০ জন কর্মরত। ১০ জন সিনিয়র কনসালট্যান্টের মধ্যে শুধু অর্থো সার্জারির চিকিৎসক রয়েছেন। মেডিসিন, সার্জারি, শিশু, গাইনি, চর্ম ও যৌন, কার্ডিওলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, ইএনটি, অ্যানেস্থেশিয়ার সিনিয়র কনসালটেন্ট পদগুলো শূন্য। বর্তমানে প্রতিদিন আউটডোরে দেড় হাজারের বেশি মানুষ সেবা নিচ্ছেন এবং ১০০ শয্যার হলেও ইনডোরে আড়াই শতাধিক রোগী ভর্তি থাকছেন। বর্তমানে আল্ট্রাসাউন্ড বন্ধ রয়েছে এবং ফার্মেসি থেকে রোগীরা মাত্র ১৭ ধরনের ওষুধ পাচ্ছেন।

এছাড়া রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ৫০ শয্যার বিপরীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনবলের তীব্র অভাব রয়েছে। এর মধ্যে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ ২১ জন চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ১০ জন কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া ১০ জন জুনিয়র কনসালটেন্টের মধ্যে মেডিসিন, গাইনি, অ্যানেস্থেশিয়া, শিশু কনসালটেন্টসহ ৪ জন কর্মরত থাকলেও সার্জারি, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন রোগের কোনো কনসালটেন্ট নেই।
পাংশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ ২১টি পদের বিপরীতে ১০ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এছাড়া ১০ জন জুনিয়র কনসালট্যান্টের মধ্যে গাইনি, অ্যানেস্থেসিয়া ও চক্ষু কনসালটেন্ট রয়েছেন। মেডিসিন, সার্জারি, চর্ম ও যৌন, কার্ডিওলোজি, অর্থোপেডিক, ইএনটি রোগের কোনো কনসালটেন্ট নেই। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্যাথলজিস্ট পদটি এবং অ্যানেস্থেটিস্ট পদটিও শূন্য। ৩ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ২ জন কর্মরত।
আরও পড়ুন
শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবার চেয়ে দুর্ভোগ বেশি
ওসমানী হাসপাতালে ঘাটে ঘাটে দুর্ভোগ-হয়রানি
যশোরে তরুণদের মধ্যে বাড়ছে এইচআইভি সংক্রমণ
অন্যদিকে বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালেও দেখা গেছে একই চিত্র। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল। অধিকাংশ পদ শূন্য রেখেই কোনো রকমে চলছে সেবা কার্যক্রম।

সেবাপ্রত্যাশীরা বলেন, জেলার চিকিৎসা সেবা খুবই নিম্নমানের। একটু জটিল রোগী নিয়ে আসলেই নামমাত্র সেবা দিয়ে রেফার্ড করে দেওয়া হয়। আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়ালে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে এসে দেখা যায় ডাক্তার নাই, রুম তালা মারা অথবা কোনো কারণে আসেন নাই।
তারা বলছেন, বাইরে থেকে বেশি ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখানোর সাধ্য নাই। সরকারি হাসপাতালে একটু সুবিধার জন্য আসলেও দেখা যায় এখানে সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি হয়। তার ওপর আবার সব ধরনের ওষুধ পাওয়া যায় না।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তারা চিকিৎসক সংকট, দুর্বল পরিবেশ ও ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
চিকিৎসা না পাওয়া ও হয়রানির অভিযোগ তুলে ভর্তি থাকা রোগী টোকন মোল্লা বলেন, হাসপাতালে অনেক রোগী, সে অনুযায়ী ডাক্তার নাই এবং আমরা সেবাও ঠিকমতো পাই না। ডাক্তার দিনে একবার আসেন, কোনো রকম দেখে চলে যান এবং প্রায় সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।
হাজী আব্দুল মান্নান নামের আরেক রোগী বলেন, ডাক্তার না থাকার বিষয়টি সিরিয়াল কাটার আগেই জানানো হয় না। তাই ডাক্তার না দেখিয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছি।

আকতার মুসল্লি বলেন, দূর থেকে ভাড়া দিয়ে এসেও এক মাস পর এসে দেখেন ডাক্তার নেই। বাইরে বেশি ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য তার নেই।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মোহাম্মদ হান্নান জানান, এই চিকিৎসক সংকটের কারণে মানসম্মত সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ১০০ বেডের হাসপাতাল হলেও ইনডোরে ভর্তি থাকা আড়াইশ’র বেশি রোগীর মধ্যে ১০০ জনের বেশি রোগীকে ওষুধ ও খাবার দিতে পারি না। তবে ২৫০ শয্যার নতুন ভবন বুঝে পেলে সেবার মান বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মোহাম্মদ হান্নান বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে আউটডোরে ১৫শ থেকে ১৬শ নতুন রোগী টিকিট কেটে সেবা নেয় এবং ইনডোরে গড়ে আড়াইশ’র ওপর রোগী ভর্তি থাকে। এছাড়া জরুরি বিভাগে দুই থেকে আড়াইশ রোগী চিকিৎসা নেয়।
তিনি বলেন, হাসপাতালের সব ধরনের চিকিৎসার জন্য ৪৩ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও পদায়ন রয়েছে মাত্র ২০ জন। এই চিকিৎসক সংকটের কারণে মানসম্মত সেবা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর তারা আশ্বস্ত করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক পাইনি।
আরও পড়ুন
‘ডাক্তার হঠাৎ এলেও দালাল আসে নিয়মিত’
লোডশেডিংয়ে থেমে থাকে অপারেশন, ৯ বছরেও চালু হয়নি আইসিইউ
ডা. শেখ মোহাম্মদ হান্নান আশা প্রকাশ করেন, ৪৮তম বিসিএস-এর কিছু ডাক্তার হয়ত আমরা পাব। তবে সেবার মান ঠিক রাখতে হলে ডাক্তারের বিকল্প নাই।

সিভিল সার্জন ডা. এসএম মাসুদ বলেন, রাজবাড়ীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন ও উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অনেক চিকিৎসক পদায়ন থাকলেও ২২ জন চিকিৎসক ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সংযুক্তিতে রয়েছেন। এই সংযুক্তির কারণে পদগুলো শূন্য দেখাচ্ছে না। ফলে নতুন ডাক্তারও পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে যারা কর্মরত আছেন, তাদের দিয়েই কোনোভাবে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
ডা. মাসুদ আরও বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছেন। নিজেদের সক্ষমতার বাইরে গেলেই উপজেলা পর্যায় থেকে জটিল ও কঠিন রোগীদের রেফার্ড করা হয়, তবে কারণ ছাড়া কোনো রোগী রেফার্ড করা হয় না। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে ভালো মানের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, যা সেবন করে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছেন।
রুবেলুর রহমান/কেএইচকে/জেআইএম

5 days ago
7








English (US) ·