হেমন্তে ঝরা হিমঝুরি
রাজধানী
মৃত্যুঞ্জয় রায় 2025-11-05হেমন্ত আসে ছাতিমের গন্ধে ও শোভায়। ছাতিম এ দেশে সুলভ উদ্ভিদ। গ্রামে তো বটেই, শহরেরও অনেক জায়গায় ছাতিম গাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সন্ধ্যা হতেই এর তীব্র ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করে। হেমন্তে আর একটি সুগন্ধি ফুল ফোটে, নাম তার হিমঝুরি। এটি দুর্লভ উদ্ভিদ।
হিমঝুরি ফুল ফুটল কিনা, তা দেখার জন্য গত ৩০ অক্টোবর ভোরে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের কাছে। সেখানে পথের পাশে দাঁড়ানো লম্বা গাছটির তলায় গিয়ে দাঁড়াই। যেভাবে ফুল দেখব বলে আশা করেছিলাম, সেভাবে ফোটেনি। একেবারে মগডালের আগায় সাদা সাদা কয়েকটা ফুল দেখতে পেলাম। আসলেই হিমঝুরি ফুটেছে কিনা, তা যাচাই করতে গাছটার তলায় তাকালাম। গার্ডরুমের পাশে ঘসের ওপর, রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর পড়ে আছে হিমঝুরি ফুল। গাছে ফুল দেখতে হলে আসতে হতো রাতের বেলায়। কী আর করা, তবু পুষ্পদর্শন তো হলো। এটুকু অন্তত বুঝলাম, হেমন্তে হিমঝুরি ফুটতে শুরু করেছে। কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে হালকা মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেলাম।
হিমঝুরি ফুলের লম্বা সরু নল, আর সেই নলের মাথায় ছড়িয়ে থাকে পাঁচটি পাপড়ি। তিনটি পাপড়ি আলাদা। পাপড়িগুলোর মাঝখানে সরু সাদা সুতোর মতো পরাগদণ্ডের মাথায় রত্নের মতো চিকচিক করে হালকা বাদামি রঙের পরাগধানী। পুষ্পনল ও পাপড়িসহ ফুলের দৈর্ঘ্য মেপে পেলাম ৯ সেন্টিমিটার, পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুলের পাপড়ির বিস্তার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত আড়াই সেন্টিমিটার। ফুলটি যে এত বড় হতে পারে, মাপার আগে ডালে থাকা ফুলগুলোকে দেখে তা মনে হয়নি। বই পড়ে ফুলগুলোকে খুব ছোট ভাবতাম।
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলা থেকে কলকাতায় ট্রেনে যাওয়ার সময় এক অখ্যাত স্টেশনে এ ফুলের দেখা পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বসলাম একটি বেঞ্চে। হঠাৎ দেখি আমার গায়ে পাশের আকাশছোঁয়া একটি গাছ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি ফুল ঝরছে। মুহূর্তেই হিমঝুরি নাম মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। আকাশনিম আমার চেনা গাছ।’
হিমঝুরির আরেক নাম পেলাম আকাশনিম বা আকাশমল্লি। নিমগাছের মতো পাতার গড়ন, আকাশের দিকে মুখ তুলে তার ফুল দেখতে হয়, এ জন্যই কি এর নাম হয়েছে আকাশনিম? কবি বিষ্ণু দে লিখেছিলেন– ‘শিরীষে আকাশনিমে নানা বনস্পতি মহীরুহে/ স্বদেশ আত্মার মূর্তি।’
হিমঝুরি বা আকাশনিম গাছ এ দেশে এসেছে মিয়ানমার ও ভারত থেকে। নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া তাঁর ‘নগরে নিসর্গ’ বইয়ে লিখেছেন– ‘বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন বসু এ গাছের চারাটি কলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে এনেছিলেন। তখন এখানে তাঁর বাসা ছিল।’
রমনা পার্কে সম্প্রতি এর চারা লাগানো হয়েছে। ধানমন্ডিতে ছায়ানটের গেটের পাশে একটি হিমঝুরি গাছ আছে। সেটির চারা শান্তিনিকেতন থেকে আনা হয়েছিল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও ২০২৩ সালে একটি গাছ লাগানো হয়েছিল। নারিন্দার প্রাচীন খ্রিষ্টান কবরস্থানের মধ্যে থাকা গাছটি ঝড়ে ভেঙে মরে গেছে। এ ছাড়া আর তেমন দেখা যায় না এই গাছ।
হিমঝুরির ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান কর্ক ট্রি বা ট্রি জেসমিন। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Millingtonia hortensis ও গোত্র বিগ্নোনিয়াসি। গাছ বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ বৃহৎ বৃক্ষ প্রকৃতির। ডালপালার আগা নোয়ানো বা দোলানো। ডালপালায় প্রচুর পাতা, পাতাগুলো যৌগিক, পত্রক কিনারা খাঁজকাটা, অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ। ফুল ফোটে নভেম্বর-ডিসেম্বরে, রাতের বেলায়। ফল সরু, লম্বা, আগা ও গোড়া সূচালো, সরু সরু ডানাযুক্ত বীজে ভরা। ফল ফেটে বীজ দূরে ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটির তলায় দেখলাম কয়েকটা চারা গজিয়েছে। সেগুলো তুলে বা বীজ থেকে চারা তৈরি করে বিভিন্ন উদ্যানে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগিয়ে হিমঝুরিকে সুলভ করা যেতে পারে। তবে রাস্তার ধারে না লাগানো ভালো। কেননা, এ গাছের কাঠ ও ডালপালা নরম, সহজে ঝড়-বাতাসে ভেঙে যায়।
লেখক : কৃষিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
© Samakal

1 day ago
2









English (US) ·