হোসাফ পাওয়ারের ৪৮৪ কোটি টাকার ঋণ গোপন
বাংলাদেশ
ওবায়দুল্লাহ রনি 2025-11-05বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি হোসাফ পাওয়ার। তার ৪৮৪ কোটি টাকা ঋণের তথ্য আড়াল করে পুরো দায় নিয়মিত দেখিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। তবে নতুন করে ৯৬ কোটি টাকার এলসি সুবিধা নিতে গেলে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে। ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ পাওয়ারের চলতি মূলধন ঋণ এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংক গত বছর থেকে দেখিয়ে আসছিল ৬৭৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই অনিয়মের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। একই সঙ্গে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর নির্দেশ দিয়েছে। এই অনিয়ম ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখায়। শাখাটি হোসাফ গ্রুপের মালিকানাধীন ভবনে অবস্থিত।
চলতি মূলধনের বাইরে ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্বে হোসাফ পাওয়ারকে চার ব্যাংকের দেওয়া ৬৭১ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণেও অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে এই কোম্পানির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। চলতি মূলধন ও প্রকল্প ঋণ মিলে ইসলামী ব্যাংকে এককভাবে হোসাফের ঋণ এক হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। এটি একক গ্রাহকের ঋণসীমার লঙ্ঘন। একটি ব্যাংক কোনো একক গ্রাহককে তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ সরাসরি (ফান্ডেড) ঋণ দিতে পারে। বিগত সরকারের সময়ে বড় অঙ্কের জালিয়াতির কারণে ইসলামী ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ গ্রুপের মালিকানাধীন হোসাফ পাওয়ারের চলতি মূলধনের সীমা ৮০০ কোটি টাকা। সিন্ডিকেশন ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্বে চারটি ব্যাংক ২০১৯ সালে হোসাফ পাওয়ারকে প্রকল্প ঋণ নেয়। এই ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৭১ কোটি টাকা, যা আগেই খেলাপি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬৮ কোটি টাকা পাবে ইসলামী ব্যাংক। অন্য তিন ব্যাংকের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ১৩৫ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ১১০ কোটি ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৫৭ কোটি টাকা পাবে।
সিন্ডিকেশন ঋণ খেলাপি হওয়ার বিষয়ে গত ২২ এপ্রিল মতিঝিলে চার ব্যাংক ও হোসাফ পাওয়ারের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। সেখানে হোসাফ পাওয়ারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডলারের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে বিনিময় হারে লোকসান, পিডিবি থেকে বকেয়া আদায় না হওয়া, কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়েছে। পুনঃতপশিল করলে প্রকল্পটি ভালো করে চালানো সম্ভব। বৈঠকে ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট (এককালীন জমা) দিয়ে ছয় বছরের জন্য পুনঃতপশিলে সম্মত হয় ব্যাংকগুলো। তবে হোসাফ পাওয়ার এখনও ডাউন পেমেন্টের টাকা জমা দেয়নি। সূত্র জানায়, যে প্রক্রিয়ায় এই ঋণ দেওয়া হয়েছে, তাতে এটি খেলাপি হওয়ার কথা নয়।
হোসাফ গ্রুপের পরিচালক মাবরুর হোসেন সমকালকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে সময়মতো বিল না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধে সমস্যা হয়েছে। তারা আশা করছেন, চলতি মাসের মধ্যেই একটি বিল পাওয়া যাবে। বিল পাওয়ার পর এসব ঋণ নিয়মিত হয়ে যাবে।
সিন্ডিকেশন ঋণের চুক্তি অনুযায়ী, সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা জমা হয় ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখায় খোলা একটি ‘এসক্রো’ হিসাবে। এ ধরনের ব্যাংক হিসাবে কাউকে পরিশোধের জন্য অর্থ জমা রাখা হয়। সেখান থেকে সব ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সমন্বয় হওয়ার কথা। এরপর অতিরিক্ত অর্থ থাকলে তা গ্রাহক বা ঋণগ্রহীতা পাবেন। তবে ইসলামী ব্যাংক এই শর্ত ভঙ্গ করে হোসাফ পাওয়ারকে সরকার থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ বিক্রির বিলের অর্থ নগদে তুলে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ফলে সিন্ডিকেশন ঋণ সমন্বয় না হয়ে তা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে হোসাফ পাওয়ার জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে অবস্থিত প্রকল্প থেকে ১৫ বছর ধরে বিদ্যুৎ কিনতে চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান সমকালকে বলেন, হোসাফ পাওয়ারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি তিনি অবগত। তবে পুরো অবস্থা জেনে তিনি পরে মন্তব্য করতে পারবেন।
বিষয়টি যেভাবে সামনে এলো
ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ পাওয়ারের খেলাপি ঋণ ও সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ অনেক দিন আড়ালে ছিল। চলতি বছরের ১৫ মে প্রতিষ্ঠানটির ৭৯ লাখ ডলারের নতুন একটি এলসি খোলার অনাপত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনলাইন ইমপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে তথ্য আপলোড করে ব্যাংক। ব্যাংকের দেওয়া কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুঁজে পায়, আগে খোলা কয়েকটি এলসির বিপরীতে ৪৮৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি হোসাফ পাওয়ার। অথচ ব্যাংক এক বছর আগে হোসাফের বিদেশি সরবরাহকারীকে অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক এলসির দায় পরিশোধের পর ৪৮৪ কোটি টাকা হোসাফ পাওয়ারের নামে ‘ফোর্সড লোন’ হওয়ার কথা। তা না করে ইসলামী ব্যাংক তা ‘ইন্টার ব্যাংক ডেবিট অ্যাডভাইস (আইবিডিএ)’ হিসেবে কৌশলে আলাদা করে রেখেছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ হিসেবে সিআইবিতে তা প্রতিফলিত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ পাওয়ারের অনুমোদিত ঋণসীমা ৮০০ কোটি টাকা। তথ্য গোপন না করলে চলতি মূলধনসহ গ্রাহকের ঋণস্থিতি দাঁড়াত এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। নির্ধারিত সীমার চেয়ে যা ৩৬৩ কোটি টাকা বেশি। সীমাতিরিক্ত ঋণ সমন্বয় না করে আগের দায় নবায়নের সুযোগ ছিল না। আবার গোপন করা অংশ সিআইবিতে ‘আপলোড’ করলে এলসি বা অন্য কোনো সুবিধা দেওয়া সম্ভব হতো না। তথ্য গোপনের মাধ্যমে এই ঋণ খেলাপি না করে গ্রাহককে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এভাবে প্রতিষ্ঠানটির ঋণস্থিতি দেখানো হচ্ছে ৬৭৯ কোটি টাকা, যাতে অঙ্কটি নির্ধারিত সীমার নিচে থাকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গোপন করা ঋণের পুরোটাই বেশ আগে খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি খোলা ১০টি এলসির বিপরীতে ১১৯ কোটি টাকা এবং একই বছরের ৩০ এপ্রিল খোলা অপর তিনটি এলসির বিপরীতে ৫১ কোটি টাকা এখন মন্দ মানের খেলাপি। আর গত বছরের ২৩ অক্টোবর ১২টি এলসির বিপরীতে পরিশোধ করা ১০৫ কোটি টাকা ‘সন্দেহজনক’ মানের খেলাপি। বাকি ২০৯ কোটি টাকা সাধারণ খেলাপি ধরা যায়।
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখার ব্যবস্থাপক মো. আশরাফ আলী সমকালকে বলেন, ঋণের তথ্য গোপন করে হোসাফ পাওয়ারকে সীমাতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়নি। আগের দায় পরিশোধ না করা পর্যন্ত নতুন করে সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যার জবাব দেওয়া হয়েছে।
ঋণ সমন্বয় না করে টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিডিবি থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ বিক্রির টাকায় সব ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ হওয়ার কথা। কিন্তু হোসাফ পাওয়ারকে সিন্ডিকেশন অর্থায়নের আওতায় দেওয়া ঋণের শর্ত ভঙ্গ করে টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ইসলামী ব্যাংক অর্থ উত্তোলনের সুযোগ না দিলে গ্রাহকের পক্ষে কোনোভাবে তা তুলে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এ অনিয়মের বিষয়ে খতিয়ে দেখে ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখা এবং প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখার ব্যবস্থাপক বলেন, ঋণ সমন্বয় না করে সরকারি বিলের টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। সরকারকে শুল্ক পরিশোধের জন্য গ্রাহককে কিছু অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, সরকারের কাছে হোসাফ পাওয়ার ৪০০ কোটি টাকার বেশি পাবে। সরকার এই অর্থ দিলে সিন্ডিকেশনে যারা আছে, তাদের কিস্তি পরিশোধ হয়ে যাবে। আবার ইসলামী ব্যাংকের ‘আইবিডিএ’ দায়ও অনেকাংশে সমন্বয় হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ব্যাখ্যা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারের কাছে পাওনা সামান্য
হোসাফ পাওয়ার বলছে, সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা পেলে তারা ঋণ পরিশোধ করবে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর এক হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে সরকারের কাছে হোসাফের পাওনা খুব বেশি নয়। তারা এ মুহূর্তে সরকারের কাছে পাবে ২৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক মুদ্রার দর ওঠানামাজনিত লোকসানের কারণে আরও প্রায় ২২৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডলারের দর ওঠানামাজনিত লোকসানের বিপরীতে সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে না। তবে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় দিতে গত বছরের ২৭ নভেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বলা হয়, বিনিময় হারজনিত কারণে ক্ষতির মুখে পড়া গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ আট বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া যাবে। তবে এই সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রম করা যাবে না। আবার কোনো ঋণখেলাপি গ্রাহককে এ সুবিধা দেওয়া যাবে না। ফলে হোসাফ পাওয়ারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই।
© Samakal

1 day ago
2









English (US) ·