কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো চায় বন্দর

4 hours ago 8

দেশের জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর এখন বছরে ৩৩ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে। ২০৩০ সালে এটা আরও ৪০ লাখ ও ২০৪০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা সবমিলিয়ে দাঁড়াবে এক কোটি ৭ লাখে, যা বর্তমান সক্ষমতার প্রায় চারগুণ।

বাড়তি এ কর্মযজ্ঞ সামলাতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের মাতারবাড়ি পর্যন্ত যোগাযোগ কাঠামোকে যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সহযোগিতা চায় চট্টগ্রাম বন্দর। বিশেষ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন।

সম্প্রতি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আয়োজিত এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। ওই বৈঠকে ২০২৫ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার ত্রি-পঞ্চবার্ষিকী চিত্র তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন অর্থাৎ, বছরে ৩৩ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে ২০৪০ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১০ দশমিক ৭ মিলিয়ন অর্থাৎ, এক কোটি ৭ লাখে উপনীত হবে।

দেশের ক্রমাগত চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বন্দর সুবিধাদি সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি অপারেটরদের পরিচালনায় বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে মানোন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রাম বন্দর বদ্ধপরিকর বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পাশাপাশি বন্দর কার্যক্রম ও টার্মিনাল সম্প্রসারিত হলেও অন্য সংশ্লিষ্ট লজিস্টিক সাপোর্ট হালনাগাদ করা না হলে বন্দরের টার্মিনালগুলোতে অভ্যন্তরীণ রিটার্ন রেট নেতিবাচক হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়।

কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো চায় বন্দর

২০৪০ সালে ১ কোটির বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার পরিকল্পনা

চট্টগ্রাম বন্দরের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪০ সালে ১ কোটি ৭ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা দাঁড়াবে। এর মধ্যে বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বছরে ১৩ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে। পাশাপাশি জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) কার্গো বাদেও ২০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে ৮ লাখ, বে-টার্মিনালে (সিটি-১) ১৮ লাখ, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) ৫ লাখ এবং লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে (এলসিটি) ৯ লাখসহ সবমিলিয়ে ৪০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তৈরি হবে।

আরও পড়ুন
বর্ধিত ট্যারিফ নিয়ে সংকট, চট্টগ্রাম বন্দর অচল হওয়ার আশঙ্কা
লাভের বন্দরে বর্ধিত মাশুল নিয়ে প্রশ্ন, বোঝা ভোক্তার কাঁধে
ভারী যান চলাচলে বেহাল মাঝিরঘাট সড়ক, ধুলা-কাদায় অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা
বন্দর মাশুল বাড়ায় দাম বাড়বে খাদ্যপণ্যের

একইভাবে চলমান প্রকল্প অনুযায়ী ২০৩০-২০৩৫ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল (সিটি-২) তৈরি হলে তাতে ১৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। পাশাপাশি ২০৩৫-২০৪০ সালের মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের টার্মিনালগুলো চালু করা গেলে নতুন করে ১৬ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তৈরি হবে। সবমিলিয়ে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তৈরি হবে ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউ।

এছাড়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল পোর্ট স্ট্র্যাটেজি প্রকল্প’ চলমান। জাইকার ওই প্রকল্প প্রতিবেদনের বেসলাইন ডাটাতেও ২০৪০ সালের মধ্যে ১০ দশমিক ৭ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি হবে। মাতারবাড়ি ডিপ সি-পোর্টের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। সবমিলিয়ে পরিকল্পনামাফিক এগোলে ২০৪০ সালে এখানে ১ কোটি সাত ৭ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে।- চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক

একাধিক প্রকল্প তিন মন্ত্রণালয়ের

বন্দরের কার্যক্রম ঘিরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সুপারিশ করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে উৎপাদিত পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বিদেশে রপ্তানি হবে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে একটি সংযোগ সড়ক বন্দরের বে-টার্মিনাল এলাকা হয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত করার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।

তাছাড়া লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ও বে-টার্মিনাল সংযোগ সড়কটি চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে তৈরি হওয়া বে-টার্মিনালের পূর্বপাশে মেরিন ড্রাইভ লিংক রোডটি বে-টার্মিনালের ডেডিকেটেড সংযুক্ত সড়কের সঙ্গে সংগতি রেখে আরও প্রশস্ত করার সুপারিশ করা হয়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আইসিডিতে কনটেইনার পরিবহনের জন্য ছয় রুটে তিন জোড়া ট্রেন চলাচল করে বাংলাদেশ রেলওয়ের। বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে আটটি রুটে কনটেইনার ট্রেন বাড়ানোর সম্ভাবনার কথা জানানো হয় প্রতিবেদনে।

পাশাপাশি লালদিয়া ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল দুটি এয়ারপোর্টগামী সড়কের পাশে হওয়ায় ওই সড়কটি সম্প্রসারণ করার বিকল্প নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ওই দুই টার্মিনালের সঙ্গে উড়াল সেতুর মাধ্যমে রেল সংযোগ স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো চায় বন্দর

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের দ্বিতীয় পর্যায়ে টার্মিনাল কার্যক্রম শুরু হলে ফাসিয়াখালি থেকে মাতারবাড়ি বন্দর এলাকার সংযুক্ত সড়কের ওপর যানবাহনের বাড়তি চাপ তৈরি হবে। এ চাপ মোকাবিলায় সড়ক, রেল ও অভ্যন্তরীণ নদী সংযোগ ব্যবস্থা সুসংহত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বর্তমানে চার লেন বিশিষ্ট ২৭ কিমি দীর্ঘ মাতারবাড়ি সংযোগ সড়কের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ।

পাশাপাশি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের চকরিয়ায় রেলওয়ের একটি স্টেশন রয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর থেকে কনটেইনারগুলো সড়কপথে ফাসিয়াখালি পর্যন্ত নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘ইন্টার মডেল রেলট্র্যাক’ মাধ্যমে চকরিয়া পর্যন্ত পরিবাহিত করা হলে, স্বল্প খরচে কনটেইনার পরিবহন করা যাবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ

২০৪০ সালে বন্দরের কর্মযজ্ঞ মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওই সভায়। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং লজিস্টিকস সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে ন্যাশনাল মাল্টি মোডাল কানেক্টিভিটিজ স্ট্র্যাটিজি তৈরি করা রেলওয়ের লোকোমেটিভ বাড়ানো এবং এ দুই মন্ত্রণালয়ের গৃহীত প্রকল্পগুলোর ডিপিপি সংশোধন ও তৈরি করার পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা চারগুণ বাড়াতে বন্দর এলাকাসহ সংলগ্ন এলাকার রাস্তা, রেলপথ ও অন্য অবকাঠামো উপযোগীকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বয় করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

একইভাবে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সরকারি পর্যায়ে চলমান বন্দরের অগ্রগতিকে জরুরিভিত্তিতে সাপোর্ট দেওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে ৩৩ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে। ইতোমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল তাদের পুরো সক্ষমতা ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে। নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন হয়েছে। পাশাপাশি বে-টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি হবে। মাতারবাড়ি ডিপ সি-পোর্টের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। সবমিলিয়ে পরিকল্পনামাফিক এগোলে ২০৪০ সালে এখানে ১ কোটি সাত ৭ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান কনটেইনার ও কার্গো পরিবহনে সড়কে চাপ বাড়ছে। রেলপথেও চাপ তৈরি হয়েছে। ২০৩০ সালের দিকে লালদিয়া, বে-টার্মিনালের একটি অংশের পাশাপাশি মাতারবাড়ির একটি টার্মিনাল অপারেশনে আসার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ২০৩৫ সালে বে-টার্মিনালের দ্বিতীয় অংশ এবং ২০৪০ সালে মাতাড়বাড়ির দ্বিতীয় অংশ অপারেশনে আসার কথা রয়েছে। এসব টার্মিনাল অপারেশনে এলে সড়ক, রেলপথে কনটেইনার ও কার্গো পরিবহনে চাপ তৈরি করবে। এ চাপ মোকাবিলার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।’

বন্দর সচিব বলেন, ‘ইতোমধ্যে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা হয়েছে। ওই সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মঈনউদ্দিন মহোদয় এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘সভায় ২০৪০ সালের চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশন সক্ষমতার সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়নের যে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, সে বিষয়ে নানান সুপারিশ উঠে এসেছে। এখন এসব সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকল্প নেওয়ার পাশাপাশি গৃহীত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article