জাপানি মা-ছেলের চোখে লালবাগ কেল্লা

7 hours ago 5

নাম না জানা জাপানি মা তার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে লালবাগ কেল্লার গেটে ঢুকছেন। হাতে ক্যামেরা, বেবি স্ট্রলার, কাঁধে ব্যাগ। ছেলেটি অবাক চোখে চারপাশ ছোটাছুটি করছে। ভেতরে লাল ইটের দেয়াল, উঁচু গম্বুজ, আর রোদে চকচক করা বাগান। মা তাকে জাপানি ভাষায় বললেন, ‘কোরে ওয়া ফুরুই ওশিরো ইয়ো। টোটেমো কিরেই নে’, অর্থাৎ ‘এটি একটি পুরোনো দুর্গ। খুব সুন্দর, তাই না?’

ছোট্ট ছেলেটি খেলার ছলে মাটি থেকে একটি পাথর কুড়িয়ে নিল। তার অজান্তেই ইতিহাস তখন তার হাতের মুঠোয়। ঢাকার কোলাহল, যানজট, ধোঁয়া...সব পেরিয়ে এখানে এসে মা-ছেলে যেন পৌঁছে গেলেন ইতিহাসের সে যুগে। এখানকার বাতাসে আছে অন্যরকম শান্তি, আর প্রতিটি ইটের গাঁথুনিতে আছে একেকটা গল্প। আছে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা মুঘল সাম্রাজ্যের মহিমা, প্রেম আর বেদনার কাহিনি।

১৬৭৮ সালে আওরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহ যখন ঢাকায় সুবাদার হয়ে আসেন, তখনই শুরু হয় কেল্লার নির্মাণকাজ। পরিকল্পনা ছিল বিশাল রাজকীয় আবাস, প্রশাসনিক ভবন, বাগান আর প্রতিরক্ষার প্রাচীর নিয়ে এক মহীয়ান কমপ্লেক্স গড়ার। কিন্তু ইতিহাসের নিয়তি ছিল ভিন্ন। আজম শাহ ঢাকায় বেশিদিন থাকেননি, চলে যান অন্য দায়িত্বে। এরপর দায়িত্ব নেন সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। তার আমলেই কেল্লা প্রায় সম্পূর্ণ হতে চলেছিল, ঠিক তখনই ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবিবি মারা যান। প্রিয় কন্যার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে তিনি নির্মাণকাজ থামিয়ে দেন। আর সেই থেকে লালবাগ কেল্লা থেকে যায় অসমাপ্ত। কেল্লার নির্মাণ কাজকে মনে করা হতে থাকে অভিশপ্ত।

জাপানি মা-ছেলের চোখে লালবাগ কেল্লা

তবু অসমাপ্ত এই কেল্লাই আজ মুঘল স্থাপত্যের জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে। সাদা মার্বেলের পরীবিবির সমাধি, তিন গম্বুজওয়ালা লালবাগ মসজিদ, দিওয়ান-ই-আম নামের নবাবি ভবন সব মিলিয়ে রাজকীয়তা উপচে পড়ছে।

দেয়ালের লালচে রং সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়েছে ঠিক‌ই, তবুও তার মাঝে এখনো টিকে আছে এক গাম্ভীর্য। বোঝা যায়, ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় নয়, কখনো কখনো দেয়ালের গায়ে লেখা থাকে।

জাপানি মা-ছেলের চোখে লালবাগ কেল্লা

আজ এই কেল্লা ইতিহাসপ্রেমী মানুষদের মতোই সাধারণ দর্শনার্থীদের কাছেও আকর্ষণের কেন্দ্র। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসে ঢাকার মানুষ, আসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা, আর বিদেশিরা তো আছেনই। শুক্রবারে বা ছুটির দিনে ভেতরে ঢুকলেই মনে হয় যেন মেলার মাঠ। বাচ্চারা বাগানে খেলাধুলা করছে, কেউ মসজিদের সামনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ আবার কেল্লার দেয়ালে হেলান দিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে ফ্রেমবন্দি করছে নিজেকে।

ঢাকার ব্যস্ত জীবনের ভেতরে লালবাগ কেল্লা অনেকের জন্য এক ধরনের বিশ্রামাগার। পুরোনো দিনের সৌন্দর্য, রোদে ঝলমল বাগান আর শুকনো ফোয়ারার পাশে বসে মনে হয় যেন শহরের ভেতরেই এক অন্য শহর। ইতিহাস এখানে শুধু প্রদর্শিত হচ্ছে না, অনুভবেও মনকে জাগাচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণে এখন এটি দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী টিকিট কেটে ভেতরে যান। তারা দেখতে আসেন সেই অসমাপ্ত স্বপ্নের চিহ্ন, দেখে ঢাকার শেকড় কোথায় গাঁথা ছিল!

জাপানি মা-ছেলের চোখে লালবাগ কেল্লা

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়লে কেল্লার দেয়ালে আলো পড়ে লালচে আভা দেয়। পাখিরা বাগানের গাছে ফিরে আসে, মানুষ ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগোয়। কিন্তু বাতাসে তখনো থাকে এক ধরনের ইতিহাসের গন্ধ, যেন এই দেয়ালগুলো এখনো জীবিত। তারা জানে মুঘল রাজপুত্রের স্বপ্ন, পরীবিবির বেদনা, আর শায়েস্তা খানের হৃদয় ভাঙ্গার কথা।

জাপানি মা ছেলেকে নিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনি একবার পেছনে তাকালেন। হয়তো মনে মনে ভাবলেন ইতিহাস এত সুন্দরও হতে পারে।

জাপানি মা-ছেলের চোখে লালবাগ কেল্লা

জেনে রাখা ভালো লালবাগ দুর্গের সাপ্তাহিক ছুটি রোববার। এছাড়াও শুক্রবার বাদে অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে। ছোট বাচ্চাদের টিকেট মূল্য ১০ টাকা, বড়দের জন্য‌ ৩০ টাকা। এছাড়াও সার্কভুক্ত দেশের জন্য ২০০ এবং অন্যান্য বিদেশী পর্যটকদের জন্য ৪০০ টাকা টিকেট মূল্য।

আরও পড়ুন
শেয়াই পিঠা বাগেরহাটের শীতকালীন ঐতিহ্য
দেশের যেসব মুদ্রা হারিয়েছে, যেগুলো চলছে

কেএসকে/জেআইএম

Read Entire Article