রূপগঞ্জে রমরমা অনলাইন জুয়া

21 hours ago 5

সচ্ছল ও সাজানো-গোছানো একটি সুখের সংসার ছিল। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্নও ছিল তার। এরই মধ্যে আসক্ত হয়ে পড়েন অনলাইন জুয়ায়। এই আসক্তিই সুখের জীবনকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। নিঃস্ব হয়ে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন। অভিমানে সংসার ছেড়ে চলে গেছেন স্ত্রী।

বলছি অনলাইন জুয়ার নেশায় নিঃস্ব নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েত পাড়া এলাকার বাসিন্দা লিটন সরকারের কথা। স্ত্রী ও দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। আধাপাকা বাড়ি। রাস্তার পাশেই ছিল নিজস্ব পাকা দোকানঘর। সমাজেও তার ছিল সম্মানজনক অবস্থান। সুখের যেন কমতি ছিল না। তবে অনলাইন জুয়া তার জীবনে কাল হয়েছে।

কথা বলে জানা যায়, জুয়াড়িদের সঙ্গে চলাফেরা ছিল লিটনের। প্রতিনিয়ত তাদের খেলতে দেখে তারও ইচ্ছে জাগে খেলার। একদিন শখের বশে এক হাজার টাকার বাজি ধরেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি জিতেও যান। সেই থেকেই নেশায় পেয়ে বসে তাকে। প্রথম মাসেই অনলাইন বাজিতে ছয় লাখ টাকা জিতে যান। এরপর থেকেই নিয়মিত বাজি ধরতে থাকেন লিটন। প্রথমদিকে জিতলেও কিছুদিন পর থেকেই হারার সংখ্যাটা বেড়ে যায়।

হারা টাকাগুলো ওঠানোর জন্য বড় অংকের বাজি ধরতে শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যে জমানো নগদ টাকা শেষ হয়ে যায়। হেরে যাওয়া সে টাকা ওঠাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার নিয়ে এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে খেলা চালিয়ে যান লিটন। কিন্তু হেরে যাওয়া টাকা ওঠা তো দূরের কথা, বাজিতে জেতার চেয়ে হারেনই বেশি।

একপর্যায়ে পাওনাদার ও বিভিন্ন সমিতি থেকে নেওয়া কিস্তির ঋণের চাপে দুই কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। তারপরও পুরো ঋণের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন সাইট, আইপিএল, বিপিএলসহ বিভিন্ন গেমে বাজি ধরে আজ সবকিছু হারিয়েছেন লিটন। মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে ঘর, বসতবাড়ি ও রাস্তার পাশের দোকান বিক্রি করেছেন। কিন্তু তাতেও শেষ হয়নি তার ঋণ। এখনো তাকে তাড়া করে তিনটি ঋণের কিস্তির চাপ। সব হারিয়ে ভাইদের বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে রিটনকে। অন্যের দোকানে করছেন কাজ।

অভাব-অনটন আর অভিমানে তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। বড় ছেলেটা অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। তার লেখাপড়াও বন্ধ। অন্যের সেলুনের কাজে লাগিয়েছেন ছেলেকে।

শুধু লিটন সরকারই নয়, সর্বনাশী অনলাইন জুয়ায় উপজেলার শত শত যুবক আজ নিঃস্ব। উপজেলার তারাবো পৌর এলাকার বাবুল মিয়া অনলাইন জুয়ার আসক্তিতে উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ার অটোরিকশা বিক্রি করেছেন। এখন স্টিল মিলে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কাজ করেন। মাসাব এলাকার মোকারম, নবিরুল, আজিজুল, কায়েতপাড়া ইউনিয়নের কামশাইর এলাকার মিশুক, মোমেন, প্রসেনজিৎ কায়েত পাড়া এলাকার হাফেজ, মাঝিনা এলাকার হাসিবুর, স্বপনসহ অসংখ্য যুবক অনলাইন জুয়ার আসক্তিতে সহায় সম্বল হারিয়ে আজ নিঃস্ব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ তরুণ ও শ্রমজীবী মানুষের বিশাল একটি অংশ ভার্চুয়াল জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ হলেও এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আশানুরূপ নয়। ফলে ঝুটঝামেলা ছাড়াই তরুণরা বাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বসে অনায়াসেই খেলছে জুয়া।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় নির্জন স্থানে আবডালে জুয়াড়িদের দেখা মিললেও বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে মোবাইল ফোনেই চলছে জুয়া খেলা। অনলাইন জুয়ায় সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট ও রাতারাতি ধনী হয়ে যাওয়ার প্রলোভনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। ফলে বুঝে না বুঝেই অনলাইন জোয়ার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ছে। অনেকেই শুরু করে মজা করে, পরে সেই মজাই ভয়াবহ আসক্তিতে পরিণত হয়। জুয়ার অ্যাপগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে, যার ফলে শুরুতে লাভ পাওয়া যায়। এতে কৃষক, তরুণ, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছেন মরণনেশা জুয়ায়। পড়ে ফেঁসে যাচ্ছেন তারা।

ক্রিকেট, ফুটবল, তিন পাত্তি, রামি, রঙের খেলা, এভিয়েটর গেম, আইপিএল বেটিং এমনকী জনপ্রিয় লুডু খেলাটিও আজ অনলাইন জুয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। জুয়ার খপ্পড়ে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন:
গৃহপরিচারিকা থেকে চা দোকানি—জুয়ায় নিঃস্ব সবাই
জুয়ায় বাজি ধরে কেউ খুইয়েছেন জুয়েলারি দোকান, কেউ ছেড়েছেন দেশ
শহর থেকে গ্রামে অনলাইন জুয়ার বেপরোয়া ফাঁদ
অনলাইন জুয়ার টাকা দিয়ে ডাটা কেনা কি জায়েজ হবে?

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার দুটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের প্রতিটি এলাকাতেই এই অনলাইন জুয়া খেলায় মেতে উঠেছে যুবসমাজ। অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ হলেও ভিপিএন সফটওয়্যার ব্যবহার করে দিনরাত মোবাইলফোনের অ্যাপে রমরমা জুয়ার আসর চলছে। সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকার খেলা হয় এসব অ্যাপে। অনলাইন জুয়ার সাইট দুবাই, রাশিয়া, সাইপ্রাস চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। আর বাংলাদেশে আছে তাদের প্রতিনিধি।

অনলাইন জুয়ায় সব হারিয়ে নিঃস্ব লিটন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানিক নামের এক লোক সর্বপ্রথম কায়েত পাড়া ইউনিয়নে এই অনলাইন জুয়া নিয়ে আসেন। দেখতাম তারা অনেক টাকা লেনদেন করে এবং জেতে। আমারও বেশ কৌতূহল জাগতো। একদিন গোপাল দাস নামের এক লোক আমাকে খেলার অফার করে। পরে মাত্র এক হাজার টাকা বাজি ধরি এবং জিতে যাই। এরপর কিছু দিনে আমি ছয় লাখ টাকা বাজি জিতি। একপর্যায়ে আমি কাজকর্ম সমাজ সংসার ছেড়ে অনলাইন জুয়ার অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা ও এনজিও থেকে কিস্তি উঠিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে থাকি। একপর্যায়ে পাওনাদার ও বিভিন্ন সমিতি থেকে নেওয়া কিস্তির ঋণের চাপে দুই কোটি টাকা মূল্যের ভিটে বাড়িসহ এক বিঘা সম্পত্তি ও দোকান বিক্রি করতে বাধ্য হই।’

আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘একসময় আমার সচ্ছল আর সুন্দর সংসার জীবন ছিল। এই অনলাইন জুয়া আমারে নিঃস্ব কইরা দিছে। আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বড় ছেলেটার স্কুল বন্ধ করে সেলুনের কাজে লাগিয়েছি। ঋণের চাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছি। সমাজেও অবহেলিত হচ্ছি। এই জুয়া আমার জীবনটাকে শ্মশানে পরিণত করেছে।’

পেশায় একজন লেগুনা চালক রফিক (ছদ্মনাম)। একসময় নিয়মিত মোবাইলফোনে লুডু কিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে জুয়া খেলতেন। খেলতে খেলতে এমন নেশা হয় য়ে, দেনার কারণে শেষ পর্যন্ত আয়ের উৎস গাড়িটি বিক্রি করে দেন। উপার্জনের একমাত্র উৎস হারিয়ে এখন তিনি বেকার।

কাভার্ডভ্যান চালক জাহির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রিপের ফাঁকে মালামাল লোড-আনলোডের সময় এবং ট্রিপের অপেক্ষায় থাকা সময়টা দোকানপাটে অথবা গাড়িতে বসে অনলাইন গেম খেলে পার করি। কখনো জিতি আবার কখনো মালিকের জমার টাকা খেলায় হেরে ফেলি। এভাবে মহাজনের কাছে ৪০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছি। বাড়িতেও তেমন টাকা পাঠাতে পারি না। সময় পার করতে খেলতে গিয়ে এখন ঋণের জালে জড়িয়ে গেছি।’

স্থানীয় আইনজীবী ইসরাফিল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্ভব হলে আইন সংশোধন করে জুয়াড়িদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে। সর্বোচ্চ আইন করে এদের শাস্তির বিধান করতে হবে। যেন আর কেউ এসব জুয়ার সাইট খোলা এজেন্ট হিসেবে কাজ করার সাহস না পায়।’

সরকারি মুড়াপাড়া কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনলাইন জুয়ায় কিছু এজেন্ট বা প্রতিনিধিরা লাভবান হলেও একটা শ্রেণি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ব্যবহারকারীরা বুঝে বা না বুঝে এসব অ্যাপের নেশায় পড়ে যান। একবার আসক্ত হয়ে পড়লে এ গণ্ডি হতে বের হওয়া মুশকিল। এখানে আইনের সংস্কার, প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা জরুরি।’

তবে অনলাইন জুয়া রোধে পুলিশের সাইবার টিম মাঠে কাজ করছে বলে জানান রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলাম।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে চেষ্টা করা হলেও এ সাইডগুলোর কন্ট্রোল আমাদের হাতে নেই। কেউ যদি এ অপরাধে আমাদের কাছে ধরা পড়েন, সেক্ষেত্রে আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা কিংবা জেল দিতে পারি। তবে এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন স্কুলে প্রোগ্রাম করছি। সেখানে মানুষজনকে সতর্ক করছি যেন অনলাইন জুয়ার সঙ্গে তারা যুক্ত না হন।’

এসআর/এমএস

Read Entire Article