সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, প্রিয় সহকর্মী লেখক-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিশুপ্রেমী বন্ধুরা—
আসসালামু আলাইকুম ও শুভ সকাল।
স্পষ্ট করে বলতে চাই, আজকের এই শিশুসাহিত্য উৎসব কেবল সাহিত্যিক মিলনমেলা নয়—এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক গভীর দায়বোধেরও উৎসব।
প্রযুক্তির উৎকর্ষ যুগে আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যখন একদম শিশুতোষ কাল থেকে সন্তানের হাতে প্রথম ধরা পড়ে মোবাইল ফোন, বই নয়। মোবাইল স্পর্শের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে যায় নানা ধরনের 'সেনসরি ডায়েট' কিংবা সংবেদী তথ্যউপাত্ত। মোবাইলের শব্দতরঙ্গ কিংবা নানা ধরনের দৃশ্য গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় কান ও চোখ দিয়ে ঢুকে যায় ব্রেনে; আনন্দ-উদ্দীপনা-উৎসাহ-চাহিদা তখন দখল করে ফেলে এই মোবাইল । নেট-আসক্তি, গেম, ভিডিও আর ভার্চুয়াল বিনোদনের দৌড়ে শিশু-কিশোরেরা ধীরে ধীরে বইবিমুখ হয়ে পড়ছে।
এসএসসি পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তারা
পাঠ্যবই থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে, ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার, মা-বাবাদের বিলাপ। পড়ার আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ 'সময়'কে হেলাফেলা করে শেষ করে দিচ্ছে বৃহত্তর নতুন শিশুপ্রজন্ম।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে, আমাদের শিশুসাহিত্য কি সত্যিই যুগোপযোগী? আমরা, শিশু সাহিত্যিক, শিক্ষক কিংবা মা-বাবারা কি জানি, শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতিটি স্তরে তার সাহিত্য চাহিদা কেমন?
প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে বলতে চাই, শিশুসাহিত্যের বয়সভিত্তিক পুনর্বিন্যাস এখন সময়ের দাবি। কারণ শিশুমন প্রতিটি বয়সে ভিন্নভাবে অনুভব করে, ভাবে, শেখে ও প্রতিক্রিয়া জানায়।
শিশুর বয়স বা সময়কাল
জন্মের প্রথম ২ বছর : ইন্দ্রিয় ও শব্দের জগৎ।
এই বয়সে সাহিত্য মানে ছন্দ, শব্দ, রং, সুর--মায়ের কণ্ঠের সুর, ছড়ার ধ্বনি। এই হলো প্রথম সাহিত্যভাষা।
লক্ষ্য কী?
মমতার বন্ধন সুদৃঢ় করা ও ভাষার প্রথম সংস্পর্শের মাধ্যমে মননশীলতা আলোড়িত করা।
জন্মের প্রথম চার সপ্তাহ বয়সীকে বলে 'নবজাতক'(neonate),
প্রথম বছরকে বলে Infancy আর প্রথম দুই বছর হলো প্রাক-শৈশব বা বেবিহুড। দুই থেকে তিন বছরকে টডলার এজ বলা হয়ে থাকে- যে শিশু টলতে টলতে চলে, ভালোভাবে হাঁটতে শেখেনি, তাকে টডলার বলা হয়। এ সময় শিশুরা আঁকিবুকি করার চেষ্টা করে এবং রঙের ব্যবহারও পছন্দ করে, এমন কি যেনতেন করে লেখার চর্চাও করে থাকে। ড্রয়িং তাদের আনন্দের মাধ্যম হয়ে ওঠে- চেনা যায় এমন মানুষ, ঘরবাড়ি আঁকা শুরু করে। বড়দের উচিত রং, তুলি, কাগজসহ আঁকার অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। রঙিন ছবির বইও তার সামনে খুলে দেওয়া,পড়া। এভাবে বিনোদনের মাধ্যমে সৃষ্টিশীল জগতের দ্বার খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু বড়দের হাতে যখন তারা মোবাইল দেখতে পায় তখন এই সৃজনশীল জগৎ আড়ালে থেকে যায়। আরও মনে রাখা উচিত, এ ধরনের টডলাররা সুযোগ পেলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবে, বড়দের অস্থির করে তুলবে, শব্দের অর্থ বুঝতে নিজেরাও অস্থির হয়ে উঠবে। ধৈর্য হারানো যাবে না। তাদের সৃজনশীল পথে ধরে রাখার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। ধৈর্য ধরে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে হবে।
শৈশবকালকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে: প্রারম্ভিক শৈশব (২ থেকে ৫/৬ বছর) এবং এরপর শৈশবের শেষ-পর্যায় (৫ থেকে ১১ বছর)।
সময়কালের হিসাবটা কেন জানতে হবে বাবা-মা, শিক্ষক কিংবা শিশুসাহিত্যিকদের?
কারণ ২ থেকে ৫ বছর কল্পনার বীজ বপনকাল
প্রাথমিক এই শৈশবে ভাষা বিকাশ পায়, কল্পনা ডানা মেলে। সৃজনশীলতার বিকাশ দ্রুত হয়, পরিবেশের উদ্দীপনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়। তবে এই বয়সে গাইডেন্সের প্রয়োজন আছে যেটা সাহিত্যের মাধ্যমেও করা সম্ভব।
তাদের জন্য দরকার ছবি, রং, প্রাণীর গল্প, পুনরাবৃত্তি, ছড়াগল্প। এসময় নৈতিক শিক্ষা নয়—আনন্দ ও কৌতূহল জাগানো বা তাদের কৌতূহলী মনকে তৃপ্ত করা আসল লক্ষ্য।
কল্পনাশক্তি বিকাশের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
কারণ স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি, সৃষ্টিশীলতার মতো কল্পনাও মেধার গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষদ। দু'বছর থেকে শিশু কল্পনা শুরু করে, থেমে যায় না; চলতেই থাকে। পাঁচ বছরের পর কল্পনা ও বাস্তবতার পার্থক্য বুঝতে পারে, তারপরও মন থেমে যায় না। কারণ কল্পনার মাধ্যমে আনন্দ পেয়ে থাকে তারা। তবে মনে রাখা দরকার, কল্পনার আগে স্মৃতিশক্তি বিকশিত হয়। ছয় মাস বয়সের পূর্বে একটি শিশু মানুষ চিনতে পারে, চারপাশে পরিচিত মুখ থাকলে উল্লসিত থাকে, তৃপ্ত থাকে। অচেনা মুখ দেখলে কান্না জুড়ে দিতে পারে, অচেনা জায়গা, শব্দ, দৃশ্য কিংবা প্রাণী দেখলে ভয় পেতে পারে- সবকিছু প্রমাণ করে শিশুর স্মরণ রাখার ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে। আর তাই অল্প বয়স থেকে মধুময় স্মৃতির ছাপ ফেলে দেওয়ার জন্য পারিবারিক পরিবেশের গুরুত্ব বেশি। কী বৈশিষ্ট্য নিয়ে সে বড় হচ্ছে, কাদামাটির বয়সে তার আদল গড়ে দেয় পরিবার। বড়দের হাতে বই দেখলে তারা বইমুখি হবে আর মোবাইল দেখলে মোবাইলমুখী হবে। কোনো নিস্তার নেই।
৬ থেকে ১২ বছর : চিন্তা ও অনুসন্ধানের সময়
এ সময় শুরু হয় যুক্তিবোধ, ভাবনা। তারা জানতে চায়, প্রশ্ন করতে শেখে। এসময় রূপকথা, আজব বিষয়, অভিযান, বিজ্ঞানকল্প, হাস্যরস—সবই প্রিয়; তবে গল্পে মানবিকতা, নৈতিকতা, সহানুভূতি, সততা—এই মূল্যবোধগুলো ফুটে ওঠা প্রয়োজন।
১৩ থেকে ১৯ বছর : আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধের সন্ধান
এ বয়সে কিশোরেরা নিজেদের পরিচয় ও স্বাধীনতা নিয়ে টানাপোড়েনে থাকে। তাদের জন্য চাই এমন সাহিত্য, যেখানে বাস্তবতা আছে, দ্বন্দ্ব আছে, চিন্তা আছে।
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, আত্মজিজ্ঞাসামূলক গল্প—যা তাদের শেখায়, নিজেকে চেনা ও ভাবায়।
শিশুসাহিত্য মানে শুধু ছোটদের জন্য লেখা নয়। এটি এক পূর্ণাঙ্গ মনোশিক্ষা, নৈতিকশিক্ষা ও সৃজনশিক্ষা।
সাহিত্য এখানে পাঠ্যবইয়ের পরিপূরক নয়— এটি হলো মন গঠনের হাতিয়ার, জীবনবোধ শেখার পথ, শব্দভান্ডার উন্নত করা বা বাক্য গঠনে সাবলীল বৈশিষ্ট্য তৈরি করে দেওয়ার অনন্য উপকরণ।
আজকের এই উৎসব আমাদের সেই সত্যটিই স্মরণ করিয়ে দিক—বয়সভিত্তিক ভাবনা, মনোভিত্তিক সৃজন আর সময়ভিত্তিক সাহিত্যই হোক শিশুসাহিত্যের নতুন দিগন্ত।
চলুন, শিশুর হাতে আবার বই তুলে দিই।
আসুন ঘরে ঘরে নয় কেবল সন্তানের ঘরেও লাইব্রেরি গড়ে তুলি। বিনোদনের অন্যান্য উপকরণ দিয়েও তাদের বইমুখী পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেই।
আসুন তাদের কল্পনাকে ফিরিয়ে দিই কাগজের পাতায়, গল্পের ছন্দে, ছড়ার সুরে।
ধন্যবাদ সবাইকে।
শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৫: চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে সভাপতির বক্তব্য।
লেখক: মনোচিকিৎসক, সাহিত্যিক।
এইচআর/এমএস

2 weeks ago
15









English (US) ·