সোয়া দুই কোটি টাকা খরচে স্কেল স্থাপন, মিলছে না সুফল

7 hours ago 4

যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সুরক্ষায় অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন বন্ধে বেনাপোল এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনটি পরিচালনায় বছরে সরকারের খরচ দুই কোটি ২৩ লাখ টাকা। তবে মিলছে না কোনো সুফল।

স্কেল পরিচালনায় নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইউডিসি কনস্ট্রাকশন বলছে, সড়কে পণ্য পরিবহনকারী বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা না পাওয়ায় তারা সেবা দিতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভোমরা, মোংলা ও নওয়াপাড়া বন্দর সড়ক বাদ রেখে কেবল বেনাপোল স্থলবন্দর সড়কে স্কেল চালু করায় এ রুটে বাণিজ্য কমার আশঙ্কায় স্কেল ব্যবহারে তাদের আপত্তি রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতিবছর সড়ক উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। তবে পণ্য পরিবহনকারী ট্রাকচালকরা সড়ক আইন না মানায় অল্প দিনেই সড়ক ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। এতে সড়কে ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনা। সড়কপথে ভারতের সঙ্গে যে বাণিজ্য হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় তার ৮০ শতাংশ হয় বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে। বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্ব সম্পর্ক বাড়াতে জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২২ সালে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সুরক্ষায় বেনাপোল পৌর গেট এলাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ওয়েস্কেল স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট ওয়েস্কেল পরিচালনায় চার কোটি ৪৭ লাখ টাকা চুক্তিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইউডিসিকে টেন্ডার দেয় সরকার। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও কর্মচারীসহ স্কেল পরিচালনায় ৪২ জন কাজ করছেন। নিরাপত্তায় রয়েছেন সাতজন আনসার সদস্য।

সোয়া দুই কোটি টাকা খরচে স্কেল স্থাপন, মিলছে না সুফল

২০২৪ সালের ১ অক্টোবর ওয়েস্কেলটি পুরোদমে চালু করতে ‘অংশীজনী সভার’ আয়োজন করে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। নির্ধারিত দিনে সেখানে উপস্থিত হন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে বেনাপোলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বাঁধ সাধেন স্কেল উদ্বোধনে। এক প্রকার নিরূপায় হয়ে স্কেল কার্যক্রমের উদ্বোধন না করেই ফিরে আসে সওজ কর্তৃপক্ষ।

অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনে প্রথম টনে পাঁচ হাজার ও দ্বিতীয় টন প্রতি ১০ হাজার টাকা জরিমানা বিধান রাখা হয়েছে। তবে স্কেলে অতিরিক্ত পণ্য শনাক্ত হলেও জরিমানা আদায় বা ওভার লোড বন্ধে কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ যেমন বিফলে যাচ্ছে, তেমনি অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনে সড়ক নষ্ট হচ্ছে।

পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলছেন, নওয়াপাড়া, মোংলা ও ভোমরা বন্দর সড়ক বাদ রেখে কেবল বেনাপোলে স্কেল চালু হলে এ রুটে ব্যবসা কমে আসবে। পাশ্ববর্তী বন্দরগুলোতে স্কেল চালু হলে বেনাপোল এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনটি ব্যবহার করবেন ব্যবসায়ীরা।

ওজন স্কেল চালু করতে বেনাপোল ট্রাক মালিক সমিতি, সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের বাধার মুখে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় এক প্রকার অসহায় হয়ে পড়েছেন স্কেলটির ইজারাদার কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আনসার সদস্যরা। নিরাপত্তাহীনতার কথাও বলছেন তারা।

বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জমান সনি বলেন, ‘পদ্মা নদীর এপারে বেনাপোলসহ আরও চারটি বন্দর রয়েছে। ভোমরা বন্দর, নওয়াপাড়া বন্দর ও মোংলা বন্দর। ভোমরা, নওয়াপাড়া ও মোংলা বন্দরে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন না করে বেনাপোল বন্দরসংলগ্ন সড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন করে আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে।’

সোয়া দুই কোটি টাকা খরচে স্কেল স্থাপন, মিলছে না সুফল

তিনি বলেন, ‘সড়ক সুরক্ষায় বেনাপোল যশোর সড়কে ওজন স্কেল স্থাপনকে সাধুবাদ জানাই। তবে অন্য তিনটি বন্দরে ওজন স্কেল স্থাপন করে একত্রে চারটি বন্দর সংলগ্ন সড়কে ওজন স্কেল চালু করার দাবি জানাই। শুধু বেনাপোলে সড়কে ওজন স্কেল চালু করা করা হলে ব্যবসায়ীরা বেনাপোল বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরে চলে যাবেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেনাপোল বন্দর। এজন্য এ স্কেল ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।’

বেনাপোলের ব্যবসায়ী এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, বেনাপোল-যশোর সড়কের পৌর গেট এলাকায় ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন করার ফলে ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেশী মোংলা, ভোমরা ও নওয়াপাড়া বন্দরে কোনো ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন করা হয়নি। বেনাপোল সড়কের ওজন স্কেল চালু করা হলে এ বন্দর দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ‘অন্য বন্দর দিয়ে ট্রাকে মাল একটু কম বা বেশি হলেও কোনো সমস্যা হবে না। তাহলে কেন আমি এ বন্দর দিয়ে মাল এনে জরিমানা দেবো? পার্শ্ববর্তী অন্য বন্দরগুলোয় ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল চালু করা হলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।’

নাভারন হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রোকনুজ্জামান বলেন, ট্রাকগুলোতে অতিরিক্ত পণ্য বহন করলেও কোনো ওজন স্লিপ না থাকায় আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারছি না। পণ্যবাহী ট্রাকের ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেনাপোল পৌর গেটে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন করা হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এ স্কেলটি চালু করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

বেনাপোল ওজন স্কেলের ইজারাদার ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের অ্যাডমিন মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্কেলের কার্যক্রম চালু করতে আমরা এখানে এসেছি। তবে একদিনও জরিমানা আদায় করা সম্ভব হয়নি। এখানে মোট ৪২ জন স্টাফ শিফট অনুযায়ী কাজ করেন। আনসার সদস্য রয়েছেন সাতজন। বিদ্যুৎ বিল, জেনারেটর খরচসহ প্রতিমাসে তাদের বেতন-ভাতা প্রায় ১০ লাখ টাকা। কার্যক্রম পুরোদমে চালু না হওয়ায় আমাদের বেতন-ভাতাও আটকে আছে।’

যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব হায়দার খাঁন বলেন, ‘অন্যান্য স্থলবন্দরের চেয়ে বেনাপোলে ট্রাকে ওভারলোড সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবুও এ বন্দরে নির্মাণ করা ওজন স্কেলটি চালু করতে ১ সেপ্টেম্বর আমরা অংশীজন সভার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন এসে হট্রগোল বাধিয়ে সভা পণ্ড করে দেয়। ফলে ওজন স্কেলটি পুরোদমে চালু করা সম্ভব হয়নি।’

যশোর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ওজন স্কেলটি পুরোদমে চালু করতে সময় লাগছে। তবে এটি চালু করতে বাধাদানকারীদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। দ্রুতই চালু হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

মনিকো ডিএনকো জেভির প্রকৌশলী মুন্না আজিজ জানান, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) আওতায় বেনাপোল এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়। সড়কসহ এর নির্মাণ খরচ ছিল প্রায় ১৭ কোটি। নির্মাণ শেষে এটি হস্তান্তর করা হয় ২০২২ সালে।

মো. জামাল হোসেন/এসআর/এমএস

Read Entire Article