আখের অভাবে চালু হচ্ছে না পঞ্চগড় চিনিকল, শ্রমিকদের হাহাকার

1 day ago 5

 

পঞ্চগড়ের একমাত্র ভারি শিল্প কারখানা ছিল পঞ্চগড় চিনিকল। বিগত সরকারের সময় অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করা হয় কারখানাটি। এতে কাজ হারিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এখন মানবেতর দিনযাপন করছেন। মিলটি বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় নষ্ট হচ্ছে কারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতি।

বকেয়া পাওনাসহ চিনিকলটি চালুর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। সরকারের পট পরিবর্তনের পর একাধিকবার মিলটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও আখচাষ বৃদ্ধি না হওয়ার অজুহাতে থেমে আছে সবকিছু।

আখের অভাবে চালু হচ্ছে না পঞ্চগড় চিনিকল, শ্রমিকদের হাহাকার

জেলার ঐতিহ্যবাহী এই চিনিকলে একসময় এক হাজার ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। আখমাড়াই মৌসুমে দিন-রাত আলোকিত থাকতো কারখানা এলাকা। এই চিনিকলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মিলগেট বাজার। চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী আর আখচাষিদের পদচারণায় মুখরিত ছিল মিলগেট বাজার। কিন্তু বছর চারেক আগে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণার পর এখন কমে গেছে সেই লোকসমাগম। সন্ধ্যার পর কারখানা এলাকা থাকে সুনসান। বেশ কয়েকটি কলোনি এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনও এখন পরিত্যক্ত। এসব পরিত্যক্ত ভবন এবং চিনিকল এলাকার আশপাশে মাদকসেবীদের আনাগোনাও বেড়েছে। পরিত্যক্ত কারখানার অবকাঠামোর ভেতরে এখন ভৌতিক পরিবেশ। অবহেলা আর অযত্নে নষ্ট হচ্ছে কারখানার মূল্যবান যন্ত্রাংশ।

আরও পড়ুন
আশা জাগাচ্ছে শ্যামপুর চিনিকল, রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ 
ঘোষণাতেই থেমে আছে পাবনা চিনিকল চালুর কার্যক্রম 
হলো না অটোমোশন, ব্রিটিশ আমলের পদ্ধতিতেই মাড়াই শেষ করলো কেরু

পঞ্চগড় চিনিকল ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৬৫ সালে সর্বোত্তরের পঞ্চগড় জেলার পুরাতন পঞ্চগড় এলাকায় ১৯৮ দশমিক ৪৬ একর জমিতে স্থাপন করা হয় পঞ্চগড় চিনিকল। ১৯৬৯ সাল থেকে শুরু হয় আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন। স্বাধীনতার পর থেকে সর্বশেষ ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৮ হাজার ৫৩৬ টন চিনি উৎপাদন করা হয় এই চিনিকলে। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় দেড় হাজার মানুষের। এছাড়া আখচাষিসহ সব মিলিয়ে চিনিকলের সঙ্গে ৪০ হাজারের মতো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

আখের অভাবে চালু হচ্ছে না পঞ্চগড় চিনিকল, শ্রমিকদের হাহাকার

তবে পুরাতন যন্ত্রপাতি এবং চিনিকল সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতায় ৯০ দশক থেকে শুরু হয় লোকসান। সর্বশেষ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মুনাফা হয়েছিল ৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। তারপর থেকে ক্রমাগত লোকসান গুণতে থাকে মিলটি। এরপর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে লোকসান গুনতে হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। সেবছর আখ মাড়াই হয়েছিল মাত্র ৪২ হাজার টন। অথচ ভরা মৌসুমে এই চিনিকলে এক সময় আখ মাড়াই হতো এক থেকে দেড় লাখ টন।

এরপর ২০২০ সালে পঞ্চগড় চিনিকলসহ বিভিন্ন এলাকার ছয়টি চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রায় পাঁচ বছর ধরেই মাড়াই বন্ধ রয়েছে পঞ্চগড় চিনিকলে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর পঞ্চগড় চিনিকলসহ ওই ছয়টি চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন। এরপর পঞ্চগড় চিনিকলে আখ মাড়াই চালু করার কথা থাকলেও জেলায় পর্যাপ্ত আখচাষ না হওয়ার অজুহাতে কাগজে কলমে আটকে আছে সেই সিদ্ধান্ত।

এদিকে চিনিকল পুনরায় চালুর বিষয়ে একাধিক চিঠিতে বলা হয়েছে কমপক্ষে তিন হাজারের বেশি একর জমিতে আখ চাষ করতে হবে। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে বাস্তবসম্মত কোনো উদ্যোগ নেই। আর আখচাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে না, এমন অজুহাতে চিনিকলটি পুনরায় চালুর উদ্যোগও থেমে আছে। তবে তদারকি বৃদ্ধি করা হলে এখনো জেলায় প্রচুর পরিমাণে আখ চাষের উপযোগী জমি রয়েছে। বর্তমানে জেলার ৩১টি আখ ক্রয় কেন্দ্রের মধ্যে চালু আছে মাত্র আটটি। এসব কেন্দ্রের আওতায় আখচাষ হয়েছে প্রায় ৮৪৬ একর জমিতে। এসব ক্রয় কেন্দ্রসহ আখচাষের জমি তদারকি করছে পাশের জেলার ঠাকুরগাঁও চিনিকল। তবে বাকি ক্রয় কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নিলে এবং জেলায় আখচাষ বৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো কর্মপরিকল্পনা নিলে আখচাষ বাড়বে বলেও দাবি চিনিকল সংশ্লিষ্টদের।

সরেজমিনে চিনিকল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চিনিকলের প্রশাসনিক কার্যালয় চালু রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তারাও বসে আছেন। অনেকে ফাইলপত্র নিয়েও ব্যস্ত। তবে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কোনো কর্মকর্তাই সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে রাজি নয়। প্রশাসনিক ভবনের সামনেই কারখানা এলাকা যেন জঙ্গল আর ঝোপ ঝাড়ে ভরে গেছে। ভেতরে সুনসান নীরবতা। কারখানার মূল ফটকে দুইজন নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। চিনিকলের কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারী বাদে অনুমতি ছাড়া অন্য কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। অনুমতি নিয়ে ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কারখানা এলাকা যেন ভূতুড়ে অবস্থা। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে আখ পরিবহনকারী ট্রাক্টর, মূল্যবান লোহার যন্ত্রাংশ। বর্তমানে পঞ্চগড় চিনিকলে অফিসে ১৮ জন, বিদ্যালয় শাখায় ৯ জন এবং নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্বে রয়েছেন ৩২ জন। একসময় এই চিনিকলে শুধু শ্রমিক-কর্মচারীই ছিলেন প্রায় দেড় হাজার। চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণার পর অনেকেই কাজ হারিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কেউ মিলগেট বাজারে পান দোকান খুলে বসেছেন, কেউ দিনমজুরি আবার কেউ রিকশা-ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।

আখের অভাবে চালু হচ্ছে না পঞ্চগড় চিনিকল, শ্রমিকদের হাহাকার

স্থানীয় যুবক মামুনুর রশিদ বলেন, আমি চিনিকলের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী ছিলাম। মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা বেকার হয়ে পড়েছি। মিলগেট বাজারে আমি একটা ছোট পান দোকান খুলে কোনোমতে চলছি। আমার মতো অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে রয়েছে। তাদের কোনো কাজ কাম নেই। বাড়িতে খেয়ে, না খেয়ে থাকছে। এই মিলটি আবার চালু হলে আমার মতো শ্রমিকরা কর্ম করে খেতে পারে।

চিনিকলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি নাইবুল হক বলেন, অবসরের টাকা ৯০ দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘ আট বছর ধরে আমরা গ্র্যাচুইটির টাকার জন্য ঘুরছি। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কোনো কারণ ছাড়াই চালু মিলটি বন্ধ করা হয়। তখন আখেরও অভাব ছিল না। এক থেকে দেড় মাসের আখ থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন আমরা আমাদের পাওনা টাকার জন্য আন্দোলন করছি।

পঞ্চগড় চিনিকলের উপ-ব্যবস্থাপক (কৃষি) ফরিদুল আলম আলম বলেন, বর্তমানে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩১টি আখ ক্রয় কেন্দ্রের মধ্যে আটটি চালু রয়েছে। আখচাষ হয়েছে প্রায় সাড়ে আটশ একর জমিতে। বিপুল পরিমাণ জমি এখনো পরিত্যক্ত রয়েছে। কিছু জমি রয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র আখচাষ করা হতো। আখচাষের উপযোগী প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ একর জমিতে আখ চাষ করা গেলে মিলটি আবারো চালু করা হতে পারে।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালে সরকারের নির্দেশে পঞ্চগড় চিনিকলে আখ মাড়াই কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল। এখন সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কোনো বক্তব্য আমার নেই।

পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহসভাপতি আবু হিরন বলেন, একটা সময় পঞ্চগড় চিনিকল আমাদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছিল। কারখানাটি বন্ধের ফলে শ্রমিক-কর্মচারীসহ আমাদের হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার চিনিকলটি চালুর উদ্যোগ নিলে চাষিরা আবারো আগের মতো আখচাষে উদ্বুদ্ধ হবেন। জেলার পাথর শিল্প, চা শিল্পের মতো এই শিল্প কারখানাটি অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করি।

এফএ/জিকেএস

Read Entire Article