রসুনের তীব্র গন্ধ, সরল চেহারার পেছনে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এক বিস্ময়ের গল্প। একসময় যা ছিল দাসদের দৈনন্দিন খাবারের অংশ, আজ তা জায়গা করে নিয়েছে রাজকীয় রান্নাঘর থেকে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসার তালিকায়। হাজার বছর আগে শক্তি জোগানোর জন্য শ্রমিকদের দেওয়া হতো রসুন, আর এখন বিজ্ঞান বলছে এই সাধারণ মসলাতেই লুকিয়ে আছে রোগপ্রতিরোধের অসাধারণ ক্ষমতা।

রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি রসুন আজ আমাদের হৃদয়ের যত্ন নেয়, ঠান্ডা-কাশি দূর করে, এমনকি শরীরের ভেতরের বিষাক্ত জীবাণুর সঙ্গেও লড়াই করে। গন্ধে তীব্র, গুণে অনন্য এই রসুন কীভাবে গরিবের থালা থেকে রাজাদের পাতে পৌঁছাল সেই প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর স্বাস্থ্যের এক অনন্য গল্প।

প্রাচীন পৃথিবীতে রসুনের পদচারণা
রসুনের উৎপত্তি মূলত এশিয়ায়, কিন্তু অভিবাসীদের হাত ধরে এটি পৌঁছে গেছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রসুন উৎপাদক দেশ হলো চীন। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, রসুন তাদের শক্তি বাড়ায় ও রোগ থেকে রক্ষা করে। এমনকি বিখ্যাত ফারাও তুতেনখামুনের সমাধিতেও রসুন পাওয়া গেছে যেন পরকালেও তাকে রক্ষা করবে।
গ্রীকরা রসুন উৎসর্গ করত দেবী হেকাটিকে, যিনি ছিলেন জাদুবিদ্যার রক্ষাকর্ত্রী। আবার চীন ও ফিলিপিনো লোককথায় রসুন ছিল ভ্যাম্পায়ার বা অশুভ শক্তি তাড়ানোর প্রতীক।

রবিন চেরি, ‘গার্লিক: অ্যান এডিবল বায়োগ্রাফি’ বইয়ের লেখক জানান, বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো রেসিপি, তিন হাজার পাঁচশ বছর আগের এক মেসোপটেমীয় স্ট্যু, তাতেও রসুনের উল্লেখ ছিল। প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসাপত্র এবার্স প্যাপিরাস-এ রসুনের ব্যবহার দেখা যায় নানা অসুখ সারাতে যেমন-শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, এমনকি পরজীবী সংক্রমণেও।
দাসের পাতে শুরু, রাজাদের টেবিলে স্থান
রোমান সৈন্যরা বিশ্বাস করত রসুন তাদের সাহস বাড়ায়। যুদ্ধক্ষেত্রের সাহসী যোদ্ধাদের সঙ্গে রসুনও ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপজুড়ে। তবে তখন এটি ছিল মূলত গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য।
রবিন চেরি বলেন, ‘পিরামিড নির্মাণে নিয়োজিত দাসেরা রসুন খেত শক্তি পাওয়ার জন্য। এটি সস্তা ছিল আর খারাপ খাবারের গন্ধ ঢাকতেও পারত।’

কিন্তু সময়ের সঙ্গে রসুনের ভাগ্য বদলেছে। রেনেসাঁ যুগে ফরাসি রাজা চতুর্থ হেনরিকে রসুন দিয়ে ব্যাপটাইজ করা হয়। তারপর থেকেই রসুন পায় রাজকীয় মর্যাদা। ধীরে ধীরে উচ্চবিত্তদের পাতে জায়গা করে নেয় এই গরিবের উপাদান।
ভিক্টোরিয়ান যুগে ইংল্যান্ডেও এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। আর আমেরিকায় ১৯৫০–৬০ দশকে অভিবাসীদের হাত ধরে রসুনের নতুন যাত্রা শুরু হয়। একসময় যে শব্দটি অবমাননাকর ছিল ‘গার্লিক ইটার’ সেই শব্দই পরিণত হয় খাদ্যরসিকতার প্রতীকে।
- আরও পড়ুন: ধোঁয়া ওঠা মোমো, স্বাদের আনন্দ নাকি ক্যালরির ফাঁদ
- চুমুতেই কমবে ওজন, বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
- ময়লা হাতই হতে পারে প্রিয়জনের ঝুঁকির কারণ
আধুনিক রান্নাঘরে রসুনের জয়যাত্রা
আজ এমন কোনো রান্নাঘর খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে রসুনের গন্ধ ভেসে আসে না। ফরাসি রন্ধনশিল্পের শেফ পল এরিক জেনসেনের মতে, ‘রসুন ছাড়া কোনো স্যুপ, মাংস বা সবজি রান্নার কথা ভাবাই যায় না।’

একসময় ডেনমার্কে রসুনকে ‘দুর্গন্ধের উৎস’ বলা হতো। কিন্তু অভিবাসীদের হাত ধরে রসুনের ব্যবহার বাড়তে থাকে। এখন জেনসেন প্রতিদিন সকালে এক কাপ স্যুপে পিষে দেওয়া রসুন খান এবং বিশ্বাস করেন এটিই তার ফ্লু প্রতিরোধের গোপন রহস্য।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে রসুন
আজকের পৃথিবীতে ৬০০-রও বেশি প্রজাতির রসুন পাওয়া যায়। আধুনিক গবেষণাও বলছে, এতে আছে এমন কিছু উপাদান যা আমাদের শরীরের জন্য আশ্চর্য উপকারী। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রসুনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্ষমতা অত্যন্ত শক্তিশালী।

ব্রিটিশ ডায়েটেটিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র বাহি ভ্যান ডি বোর বলেন, ‘রসুনে আছে অ্যালিসিন নামের সালফারযুক্ত যৌগ, যা জীবাণু নাশে সহায়ক। এতে পটাসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, ম্যাগনেসিয়ামসহ অনেক খনিজ রয়েছে।’ এছাড়া রসুনে থাকা প্রিবায়োটিক ফাইবার অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি দেয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বা পেট ফাঁপার মতো সমস্যা কমায়।

ইরানের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় সপ্তাহ রসুন ও লেবুর রস খেলে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কিছুটা কমে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় আকারের এক গবেষণায় তেমন প্রমাণ মেলেনি। অর্থাৎ, রসুনের প্রভাব ব্যক্তি ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।
রসুন খাওয়ার সঠিক নিয়ম
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন এক থেকে দুই কোয়া কাঁচা রসুন খাওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ। তবে অতিরিক্ত রসুন, বিশেষ করে খালি পেটে খেলে হজমে সমস্যা, গ্যাস বা অন্ত্রের জীবাণু ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে। সবকিছুর মতোই রসুনের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন পরিমিতি। ঠিক পরিমাণে খেলে এটি যেমন ওষুধ, অতিরিক্ত খেলে তেমনি হতে পারে অস্বস্তির কারণ।

দাসের পাতে শক্তির যোগানদাতা যে রসুন, সেটিই আজ রাজকীয় রন্ধনের প্রাণ। সময় বদলেছে, কিন্তু রসুনের গুরুত্ব কমেনি। এর ঝাঁঝালো ঘ্রাণ শুধু রান্নায় নয়, ইতিহাসেও ছড়িয়ে আছে। রসুন আমাদের শেখায় মূল্য নির্ভর করে অবস্থানে নয়, গুণে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
জেএস/

7 hours ago
3









English (US) ·